কিডনি কীভাবে শরীর থেকে বর্জ্য নির্গত করে?
কিডনি আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা রক্ত থেকে বর্জ্য এবং অতিরিক্ত পানি পরিষ্কার করে, শরীরের সঠিক তরল ভারসাম্য বজায় রাখে, এবং বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের (যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম) ভারসাম্য বজায় রাখে। এটি প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার রক্ত পরিশোধন করে এবং শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য বা টক্সিন (যেমন ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, অতিরিক্ত লবণ, এবং পানির অতিরিক্ত পরিমাণ) বের করে দেয়। কিডনি এই কাজটি কিছু বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করে।
কিডনির কার্যক্রমের জন্য দুটি প্রধান উপাদান:
-
নেফ্রন (nephron): কিডনির মৌলিক কার্যকরী ইউনিট, যেখানে রক্ত পরিশোধন করা হয়। প্রতিটি কিডনিতে প্রায় এক মিলিয়ন নেফ্রন থাকে।
-
রেনাল কর্টেক্স এবং রেনাল মেডুলা: কিডনির দুইটি প্রধান স্তর, যেখানে নেফ্রনগুলো অবস্থিত এবং সেগুলি রক্ত পরিশোধনের বিভিন্ন ধাপ সম্পাদন করে।
কিডনির বর্জ্য নির্গমন প্রক্রিয়া
কিডনি শরীর থেকে বর্জ্য নির্গত করার জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে:
১. রক্ত প্রবাহ কিডনির নেফ্রনে প্রবাহিত হয়
কিডনির প্রধান কাজ শুরু হয় যখন রক্ত রেনাল আর্টারি দিয়ে কিডনিতে প্রবাহিত হয়। কিডনির ভিতরে প্রবাহিত হওয়া রক্ত প্রথমে নেফ্রনে পৌঁছে। প্রতিটি নেফ্রনে রয়েছে কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ:
-
বোয়ম্যান ক্যাপসুল (Bowman's capsule)
-
গ্লোমেরুলাস (Glomerulus)
-
টিউবুলাস সিস্টেম (Tubular system) যা প্রোক্সিমাল কনভলিউটেড টিউবুলাস, হেনলে লুপ, ডিস্টাল কনভলিউটেড টিউবুলাস এবং কোলেক্টিং ডাক্ট দিয়ে গঠিত।
২. ফিল্ট্রেশন (Filtration):
নেফ্রনের গ্লোমেরুলাস হল রক্তের ক্ষুদ্র শিরা, যা একটি জালিকার মতো ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। গ্লোমেরুলাসে প্রবাহিত রক্ত থেকে পানি, গ্লুকোজ, অ্যামিনো অ্যাসিড, এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র অণু বের হয়ে যায় এবং বোয়ম্যান ক্যাপসুলে চলে আসে। এই প্রক্রিয়াটি ফিল্ট্রেশন বলে পরিচিত।
এই ধাপে বড় সাইজের উপাদান, যেমন রক্তকণিকা (RBC), হোর্সশু (WBC), এবং প্রোটিন (যেমন, অ্যালবুমিন) রক্তে ফিরে আসে, কারণ তাদের আকার খুব বড় এবং তারা গ্লোমেরুলাসের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে না।
৩. রিরাপ্রোপ্রেশন (Reabsorption):
বোয়ম্যান ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে যাওয়া ফিল্টারড তরলটি পরে নেফ্রনের প্রোক্সিমাল কনভলিউটেড টিউবুলাস (PCT) থেকে শুরু করে হেনলের লুপ, এবং পরে ডিস্টাল কনভলিউটেড টিউবুলাস (DCT) হয়ে কিডনির কোলেক্টিং ডক্ট-এ প্রবাহিত হয়। এই পুরো পথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় (যেমন গ্লুকোজ, অ্যামিনো অ্যাসিড, এবং কিছু সল্ট) আবার শরীরের রক্তে ফিরে চলে আসে। এই প্রক্রিয়াটি রিরাপ্রোপ্রেশন নামে পরিচিত।
ফিল্ট্রেশনের পর, শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন গ্লুকোজ এবং অ্যামিনো অ্যাসিড আবার টিউবুলাসের দেওয়াল দিয়ে রক্তে ফিরে আসে। এর পাশাপাশি শরীরের অতিরিক্ত পানি এবং লবণ (যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম) রিটেনশন বা শোষিত হতে থাকে, যা শরীরের তরল ভারসাম্য বজায় রাখে।
৪. সেক্রেশন (Secretion):
কিছু উপাদান, যেমন অ্যামোনিয়া, ক্রিয়েটিনিন, এবং কিছু অম্ল (যেমন হাইড্রোজেন আয়ন), রক্ত থেকে নেফ্রনের ডিস্টাল কনভলিউটেড টিউবুলাস (DCT) ও কলেক্টিং ডক্ট-এ সেক্রিশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে কিডনির মাধ্যমে বর্জ্য হিসেবে বের হয়ে যায়। এটি একটি একেবারে অতিরিক্ত পণ্য অপসারণ প্রক্রিয়া, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত টক্সিন এবং অপ্রয়োজনীয় পদার্থ বের করে দেয়।
৫. পানি এবং লবণের ভারসাম্য বজায় রাখা:
কিডনি হরমোন (এন্টি-ডাইইউরেটিক হরমোন বা ADH) এর মাধ্যমে শরীরের পানি শোষণ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন শরীরের পানি কম থাকে (যেমন ডিহাইড্রেশন), ADH কিডনিতে শোষণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যাতে শরীরের পানি পুনরুদ্ধার হয়। এর ফলে, কিডনি রক্তে বেশি পানি শোষণ করে এবং হালকা, ঘন মূত্র তৈরি হয়। অন্যদিকে, অতিরিক্ত পানি হলে ADH কম হয়ে যায় এবং কিডনি বেশি পানি বের করে, ফলে অল্প ঘনত্বের মূত্র তৈরি হয়।
৬. বর্জ্য নির্গমন (Excretion):
এই প্রক্রিয়ার শেষে, বাকি বর্জ্য এবং অতিরিক্ত পানি মূত্র (urine) হিসেবে কিডনির কোলেক্টিং ডক্ট থেকে কিডনি থেকে বেরিয়ে এসে মূত্রাশয়ের (bladder) মাধ্যমে শরীরের বাইরে বেরিয়ে যায়।
মূত্রের গঠন:
মূত্র মূলত পানি, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, লবণ, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন আয়ন, এবং অন্যান্য কিছু রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গঠিত। মূত্রের ঘনত্ব এবং উপাদান শরীরের অবস্থার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। যেমন:
-
ডিহাইড্রেশন বা অতিরিক্ত পানি শোষণ করার পর মূত্র ঘন এবং কম পরিমাণে হয়।
-
পুষ্টির অভাব বা রোগের প্রভাবে মূত্রে অস্বাভাবিক উপাদান দেখা দিতে পারে।
কিডনির আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা:
-
অ্যাসিড-বেস ব্যালান্স: কিডনি শরীরের অম্ল (acid) এবং ক্ষার (base) ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
-
রেনিন-এঞ্জিওটেনসিন সিস্টেম: এটি শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
-
এপোইটিন: কিডনি রক্তের শ্বেতকণিকা (RBC) তৈরি করার জন্য এপোইটিন হরমোন উৎপন্ন করে, যা রক্তের হিমোগ্লোবিন স্তর বজায় রাখে।
উপসংহার:
কিডনি শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে একটি, যা রক্ত থেকে বর্জ্য এবং টক্সিন বের করার কাজ করে, শরীরের পানি এবং লবণের ভারসাম্য বজায় রাখে, এবং শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি একটি অত্যন্ত কার্যকরী পরিশোধন যন্ত্র, যার কাজের কোনো ব্যাঘাত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকারিতাকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।