বাংলাদেশের কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, নাজুক প্রাকৃতিক পরিবেশ, এবং জলবায়ু-নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার কারণে এ খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গভীর এবং বহুমাত্রিক। নিচে এর প্রভাবগুলো তুলে ধরা হলো:
১. তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব:
-
ফসল উৎপাদন হ্রাস: তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধান, গম, এবং ভুট্টার মতো ফসলের ফলন হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চ তাপমাত্রায় ধানের ফুল ঝরে পড়ে এবং ফলন কমে যায়।
-
পশুসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত: তাপমাত্রা বৃদ্ধি পশুদের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং তাদের উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে দেয় (যেমন দুধ উৎপাদন কমে যায়)।
২. খরা এবং অনাবৃষ্টি:
-
জলসংকট: দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টি হলে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয় না, যার ফলে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কমে।
-
ফসল চাষের সীমাবদ্ধতা: বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের মতো এলাকায় খরা সহিষ্ণু ফসল ছাড়া অন্য ফসল চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
৩. বন্যা ও অতিবৃষ্টির প্রভাব:
-
ফসল ধ্বংস: অতিবৃষ্টি এবং আকস্মিক বন্যার কারণে আমন ধান, সবজি এবং অন্যান্য ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-
জমির উর্বরতা হ্রাস: বন্যার কারণে মাটির উর্বরতা কমে এবং লবণাক্ততা বেড়ে যায়, যা কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
-
মাল্টিপল ফসল চাষে বাধা: বন্যার কারণে বছরের নির্ধারিত সময়ে ফসল তোলা সম্ভব হয় না, যা কৃষি পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে।
৪. লবণাক্ততার বৃদ্ধি:
-
দক্ষিণাঞ্চলের সমস্যা: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণাঞ্চলের (খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা) মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। এতে ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য চাষে সমস্যা হচ্ছে।
-
মিঠা পানির সংকট: সেচের জন্য পর্যাপ্ত মিঠা পানি পাওয়া যাচ্ছে না, যা কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৫. চরম আবহাওয়ার ঘটনা:
-
ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস: উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস ফসল, গবাদি পশু এবং মজুদ খাদ্যের ক্ষতি করছে।
-
শিলাবৃষ্টি: শিলাবৃষ্টির ফলে বিভিন্ন ফসল এবং ফলের বাগান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৬. পোকামাকড় ও রোগের বৃদ্ধি:
-
নতুন রোগের সংক্রমণ: উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ফসলের নতুন রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে।
-
কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি: কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পরিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৭. বৈচিত্র্যময় ফসল চাষে চ্যালেঞ্জ:
-
ফসলের সময়সূচিতে পরিবর্তন: মৌসুমের অনিয়মিত পরিবর্তন (যেমন বর্ষার আগে বা পরে শুরু) কৃষি কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।
-
বিশেষ ফসলের সংকট: জলবায়ুর প্রভাবের কারণে কিছু অঞ্চলে বিশেষ ফসল (যেমন পাট, সরিষা) চাষ কঠিন হয়ে পড়ছে।
৮. গবাদি পশু এবং মৎস্য খাতে প্রভাব:
-
গবাদি পশুর খাদ্য সংকট: খরা ও বন্যার কারণে পশুখাদ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাচ্ছে।
-
মৎস্য খাতে ক্ষতি: জলাশয়ের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে মিঠাপানির মাছের প্রজনন এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
৯. কৃষকের জীবিকা এবং সামাজিক প্রভাব:
-
আয় হ্রাস: ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে কৃষকের আয় কমে যাচ্ছে।
-
গ্রাম থেকে শহরমুখী অভিবাসন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি অনিশ্চয়তায় পড়লে অনেক কৃষক শহরমুখী হতে বাধ্য হন।
সমাধান ও অভিযোজন কৌশল:
-
খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবন ও চাষ।
-
পরিবেশবান্ধব সেচ পদ্ধতির প্রচলন।
-
বন্যা প্রতিরোধী অবকাঠামো নির্মাণ।
-
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কৃষি গবেষণা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার।
-
সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা বৃদ্ধি।
বাংলাদেশের কৃষিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর নীতি এবং সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।