রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ বলতে সাধারণত এমন কর্মকাণ্ড বোঝানো হয়, যেখানে একটি রাষ্ট্র সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, বা সম্পাদন করে। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড একটি গুরুতর অপরাধ এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। নিচে সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হলো:
১. কূটনৈতিক পদক্ষেপ
(ক) নিন্দা ও নোটিশ প্রদান:
-
অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দা প্রস্তাব আনা।
-
ঐ রাষ্ট্রকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করতে নোটিশ প্রদান।
(খ) কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস বা ছিন্ন:
-
অভিযুক্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা।
-
রাষ্ট্রের দূতাবাস ও কনস্যুলেট বন্ধ করা।
২. আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা
(ক) অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা:
-
অভিযুক্ত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
-
বাণিজ্য, বিনিয়োগ, এবং প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া।
(খ) সম্পদ ফ্রিজ:
-
অভিযুক্ত রাষ্ট্রের সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পদ (যা সন্ত্রাসে ব্যবহৃত হতে পারে) জব্দ বা ফ্রিজ করা।
(গ) ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা:
-
অভিযুক্ত রাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
৩. আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ
(ক) আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা:
-
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (ICJ) বা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (ICC)-এ রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা।
-
প্রমাণিত হলে রাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য করা।
(খ) সন্ত্রাসবাদবিরোধী চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা:
-
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তি ও প্রটোকল (যেমন UN Convention for the Suppression of Terrorism) অনুযায়ী রাষ্ট্রটির কার্যক্রম পর্যালোচনা করা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৪. সামরিক পদক্ষেপ
(ক) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনে সামরিক হস্তক্ষেপ:
-
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ।
-
চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বা সীমিত সামরিক অভিযান পরিচালনা।
(খ) আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ:
-
যদি কোনো রাষ্ট্র সরাসরি সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে আরেকটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে, তবে ভুক্তভোগী রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে আত্মরক্ষার পদক্ষেপ নিতে পারে।
৫. জাতিসংঘের মাধ্যমে ব্যবস্থা
(ক) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন:
-
অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বা শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনার জন্য রেজুলেশন গৃহীত হতে পারে।
(খ) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে পদক্ষেপ:
-
নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে Uniting for Peace Resolution এর আওতায় সাধারণ পরিষদ পদক্ষেপ নিতে পারে।
৬. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জোটের ভূমিকা
(ক) আঞ্চলিক জোটের নিষেধাজ্ঞা:
-
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU), আফ্রিকান ইউনিয়ন (AU), বা অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
(খ) বহুজাতিক সামরিক জোট:
-
NATO বা অন্য সামরিক জোট অভিযুক্ত রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ দমনে ভূমিকা রাখতে পারে।
৭. জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও সমর্থন বৃদ্ধি
(ক) মানবাধিকার সংগঠন ও প্রচারণা:
-
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়া অভিযুক্ত রাষ্ট্রের কার্যকলাপ তুলে ধরে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
-
বয়কট বা প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রটির ওপর চাপ সৃষ্টি।
অভিযুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া এবং সীমাবদ্ধতা
-
অভিযুক্ত রাষ্ট্র তার স্বার্থে জোট গঠন করতে পারে বা আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিরোধের চেষ্টা করতে পারে।
-
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হলে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা রোধ করতে পারে।
-
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিরোধ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া জটিল করতে পারে।
উপসংহার
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ। এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্য এবং প্রমাণভিত্তিক বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনানুগ ও কূটনৈতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এ ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখা সম্ভব।