হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ইসলামি ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ও হৃদয়স্পর্শী অধ্যায়। এই ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তির হৃদয়ের পরিবর্তন নয় — বরং এটি ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। নিচে বিস্তারিতভাবে ঘটনাটি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হলো —
প্রেক্ষাপট-
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নবুয়ত ঘোষণার পর প্রথম দিকে মক্কার মুসলমানরা খুবই অল্পসংখ্যক ছিলেন। সেই সময় কুরাইশদের অনেক প্রভাবশালী নেতা ইসলাম বিরোধী ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হজরত উমর (রাযি.)। তিনি ছিলেন এক কঠোর, দৃঢ়চেতা, সাহসী এবং ন্যায়ের পক্ষে আপসহীন ব্যক্তি। তবে ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি ছিলেন ইসলামের অন্যতম কঠিন শত্রু।
ইসলাম গ্রহণের আগে শত্রু হিসেবে উমর (রাযি.) -
উমর (রাযি.) ইসলাম গ্রহণের আগে মুসলমানদের কষ্ট দিতেন। একদিন তিনি রেগে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন - “মুহাম্মদ (ﷺ)-কে হত্যা করবো” - যেন এভাবে ইসলামের প্রসার রোধ করা যায়।
তিনি তলোয়ার হাতে রওনা হলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে হত্যার উদ্দেশ্যে।
বোনের ঘরে ঘটনার মোড়
পথে এক ব্যক্তি (নু’আইম ইবন আবদুল্লাহ রাযি.) তাঁকে দেখে বললেন -
“হে উমর! কোথায় যাচ্ছো? তিনি বললেন- মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করতে যাচ্ছি (নাউযুবিল্লাহ্), এ কথা শুনে তিনি বললেন, হে উমর! তুমি আগে নিজের পরিবারের খবর নাও! তোমার বোন ও ভগ্নিপতি তো ইতিমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে!”
এ কথা শুনে উমর (রাযি.) ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি সরাসরি বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব (রাযি.) ও তার স্বামী সাঈদ ইবন যায়েদ (রাযি.)-এর ঘরে গেলেন।
তখন তারা হযরত খব্বাব ইবনুল আরাত (রাযি.)-এর কাছ থেকে সূরা ত্বোহা-এর আয়াত শিখছিলেন।
কুরআনের শব্দে হৃদয়ের পরিবর্তন:
উমর (রাযি.) ঘরে ঢুকে রেগে গিয়ে তার ভগ্নিপতিকে মারধর করলেন। বোন ফাতিমা (রাযি.) বাধা দিতে গেলে তাকেও আঘাত করলেন। রক্ত ঝরতে দেখে উমরের মন কিছুটা নরম হয়ে গেল। তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন- “তোমরা যা পড়ছিলে, আমাকে দাও, আমিও পড়বো।”
বোন বললেন - “তুমি অপবিত্র অবস্থায় আছো, প্রথমে গুসল করে নাও, তারপর পড়বে।”
উমর (রাযি.) গোসল করলেন, তারপর সূরা ত্বোহা-এর আয়াতগুলো পড়লেন —
طٰهٰ، مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَىٰ...
“হে মুহাম্মদ ﷺ! আমি তোমার উপর কুরআন অবতীর্ণ করিনি যেন তুমি কষ্ট পাও...” (সূরা ত্বোহা ২০:১–২)
আয়াতগুলো পড়ে তাঁর অন্তর কেঁপে উঠলো। তাঁর মুখ থেকে অজান্তেই বের হয়ে গেল - “এই কালাম তো কোনো মানুষের কথা নয়!”
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে আগমন:
এরপর উমর (রাযি.) জানতে পারলেন, নবী করিম ﷺ তখন দারুল আরকাম নামক এক ঘরে সাহাবাদের সাথে অবস্থান করছেন। তিনি তলোয়ার হাতে সোজা সেখানে গেলেন। সাহাবারা তাঁকে দেখে ভয় পেলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন - “ওকে আসতে দাও!”
উমর (রাযি.) ভিতরে ঢুকলেন, তখন নবী করিম ﷺ তাঁর জামার কলার ধরে বললেন - “হে খাত্তাবের পুত্র উমর! তুমি ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত কি থামবে না?”
উমর (রাযি.) বললেন- “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আপনি আল্লাহর রাসূল।”
এ কথা শুনে উপস্থিত মুসলমানরা “আল্লাহু আকবার” ধ্বনিতে কাঁপিয়ে দিলেন দারুল আরকাম।
ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি -
উমর (রাযি.)-এর ইসলাম গ্রহণ ছিল ইসলামের জন্য এক নতুন প্রভাত।
তিনি ঘোষণা দিলেন - “হে আল্লাহর রাসূল! এখন কি আমরা সত্য পথে নই?” “তাহলে গোপনে নয়, প্রকাশ্যে নামাজ পড়ব!”
তখন প্রথমবারের মতো মুসলমানরা দুই সারিতে ভাগ হয়ে প্রকাশ্যে কাবা শরিফে নামাজ আদায় করলেন, এক সারির অগ্রে ছিলেন হজরত হামযা (রাযি.), অন্য সারিতে হজরত উমর (রাযি.)।
উপসংহার -
উমর (রাযি.)-এর ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার মুসলমানরা বলতেন - “উমরের ইসলাম গ্রহণের আগে আমরা দুর্বল ছিলাম, তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর আমরা শক্তিশালী হলাম।”
হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন- “উমরের ইসলাম গ্রহণ ছিল বিজয়, তাঁর হিজরত ছিল সাহায্য, আর তাঁর খিলাফত ছিল রহমত।”
সূত্রসমূহ -
সীরাত ইবনে হিশাম, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ইবনু কাসির, সহীহ বুখারী (হাদীস: ৩৬৮৫), তাবরী তাফসীর ও ইতিহাস।