হজরত সুহাইব ইবন সিনান রুমী (রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে এক অত্যন্ত আবেগময়, ত্যাগ ও ঈমানদীপ্ত অধ্যায়।
তিনি ছিলেন এক অনন্য সাহাবী, যিনি ইসলাম গ্রহণের জন্য দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। নিচে তাঁর জীবন ও ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো —
♦️ প্রাথমিক পরিচয়ঃ-
হজরত সুহাইব রুমী (রাযি.)-এর পূর্ণ নাম ছিল সুহাইব ইবন সিনান আন-নমরী। “রুমী” উপাধিটি এসেছে এজন্য যে, তিনি ছোটবেলায় রোমানদের বন্দি হয়ে রোমে বড় হন, ফলে তাঁর ভাষা ও আচরণ রোমানদের মতো হয়ে গিয়েছিল।
♦️ জন্ম ও শৈশবঃ-
তাঁর জন্ম হয়েছিল ইরাকের মসুল অঞ্চলে। এক যুদ্ধে শত্রুরা তাঁকে বন্দি করে রোমে বিক্রি করে দেয়। সেখানেই তিনি বহু বছর ক্রীতদাস হিসেবে ছিলেন এবং রোমান ভাষা শিখেছিলেন। পরে তিনি মুক্তি পান এবং ব্যবসার মাধ্যমে মক্কায় চলে আসেন। মক্কায় এসে তিনি আবদুল্লাহ ইবন জুদআন নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির আশ্রয়ে থাকতেন এবং ব্যবসার মাধ্যমে ধনী হয়ে ওঠেন।
♦️ ইসলাম গ্রহণের ঘটনা -
"একদিন মক্কায় খবর ছড়িয়ে পড়ল মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ﷺ নবুয়ত ঘোষণা করেছেন এবং আল্লাহর একত্বের দাওয়াত দিচ্ছেন।"
সুহাইব (রাযি.) শুনলেন, তাঁর দাওয়াতের কেন্দ্র দারুল আরকাম, যেখানে কিছু মানুষ গোপনে ইসলাম গ্রহণ করছে। তিনি ঠিক করলেন, একবার নিজেই গিয়ে দেখবেন।
♦️ দারুল আরকামে আগমন
একদিন তিনি দারুল আরকামে পৌঁছলেন, ঠিক সেই সময় সেখানে আম্মার ইবন ইয়াসির (রাযি.)ও পৌঁছলেন। দু’জনই নবী করিম ﷺ-এর কাছে এসে একই সময়ে ঈমান গ্রহণ করলেন। এভাবে তাঁরা ইসলামের প্রাথমিক যুগের প্রথম দিকের মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হন।
⚔️ মুশরিকদের নির্যাতন
সুহাইব (রাযি.) ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার মুশরিকরা তাঁকে প্রচণ্ড কষ্ট দিতে লাগল।
তিনি ছিলেন বিদেশি, মক্কায় তাঁর কোনো গোত্র বা পরিবার ছিল না, তাই কেউ তাঁকে রক্ষা করতে পারত না। তবুও তিনি অবিচল থেকে বলতেন —
“আল্লাহর কসম! যদি তোমরা আমার দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলো, তবু আমি আমার ঈমান ছাড়ব না।”
♦️ হিজরতের সময়ের অবিশ্বাস্য ত্যাগ -
যখন নবী করিম ﷺ ও সাহাবাগণ মদিনায় হিজরত করছিলেন, সুহাইব (রাযি.)ও হিজরতের সংকল্প করলেন। কিন্তু মক্কার কাফিররা তাঁর সব সম্পত্তি আটকে দিয়ে বলল, “তুমি আমাদের শহরে এসেছিলে গরিব অবস্থায়, এখন ধনী হয়েছো। আমাদের টাকা নিয়ে তোমাকে মদিনায় যেতে দিচ্ছি না!”
তখন সুহাইব (রাযি.) বললেন - “যদি আমি আমার সব সম্পত্তি, ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদ তোমাদের দিয়ে দিই, তাহলে কি আমাকে যেতে দেবে?” তারা বলল, “হ্যাঁ।”
তিনি তখন বিনা দ্বিধায় নিজের সমস্ত সম্পদ ছেড়ে দিলেন এবং একা, নিঃস্ব অবস্থায় মদিনার পথে রওনা হলেন।
★★★ মদিনায় আগমন ও নবীর উক্তি -
যখন তিনি মদিনায় পৌঁছলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে দেখে আনন্দে বললেন - "রাবিহাল বাই'উ, ইয়্যা আবা ইয়াহইয়া!" অর্থ্যাৎ “ওহে আবু ইয়াহইয়া (সুহাইব), তোমার ব্যবসা তো সত্যিই সফল হয়েছে!”
(সূত্র: হাদীস, ইমাম হাকিম, মুসতাদরাক; হাকিম বলেছেন, সহীহ বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ)।
এ কথার অর্থ হলো —
তুমি দুনিয়ার সব কিছু হারিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে নিজেকে বিক্রি করেছো, আর এই বিক্রিই তোমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ লাভ।
♦️ নবী করিম ﷺ-এর স্নেহ -
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
তাঁর আন্তরিকতা, ত্যাগ ও ধৈর্যের কারণে তিনি নবীর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন।
নবী করিম ﷺ বলেছেন, “সুহাইব একজন উত্তম মানুষ, তিনি আল্লাহকে ভালোবাসেন এবং আল্লাহও তাঁকে ভালোবাসেন।” (তাবরানী, মুজামুল কাবীর)
♦️পরবর্তী জীবনঃ-
হজরত উমর (রাযি.) একবার তাঁকে বললেন - তুমি বড় বেশী খরচ করো। তখন তিনি উত্তরে বললেন , কখনও অপচয় করি না। যখন হজরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুশয্যায় ছিলেন, তিনি বলেছিলেন - “যতক্ষণ না মুসলমানরা নতুন খলিফা নির্বাচিত করে, ততক্ষণ নামাজের ইমাম হবেন সুহাইব (রাযি.)।” এছাড়াও হজরত উমর রাযিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর জানাযার নামাজ পড়ানোর জন্য হজরত সুহাইব রাযিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর ওসিয়ত করে যান। (তাবরী, ইতিহাস)
হজরত সুহাইব (রাযি.) জীবনের শেষ পর্যন্ত মদিনায় অবস্থান করেন। তিনি প্রায় ৩৭ হিজরি সালে ইন্তেকাল করেন।
♦️ শিক্ষণীয় বিষয় -
হজরত সুহাইব (রাযি.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা আমাদের শেখায় —
১. সত্যের জন্য সম্পদ ত্যাগ করাই প্রকৃত লাভ।
২. আল্লাহর পথে ত্যাগই প্রকৃত ব্যবসা।
৩. ধৈর্য ও ঈমানের দৃঢ়তা মানুষকে ইতিহাসে অমর করে রাখে।
♦️ সূত্রঃ- সীরাত ইবনে হিশাম, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ইবনু কাসির, সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩৮৯৪, তাবরী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলূক।