♦️ আবূ যর গিফারী রাযিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর পরিচয়
তাঁর পুরো নাম জুন্দুব ইবন জুনাদা আল-গিফারী (جندب بن جنادة الغفاري)।
তিনি গিফার গোত্রের লোক ছিলেন, যা মক্কার নিকটবর্তী অঞ্চলের একটি গোত্র। তিনি ইসলাম গ্রহণের আগেই সত্য সন্ধানী, সৎচরিত্র ও নির্লোভ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
হজরত আবূ যর আল-গিফারী (রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত সাহাবি, তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা অত্যন্ত অনন্য, হৃদয়স্পর্শী ও শিক্ষণীয়। নিচে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো —
♦️ ইসলাম গ্রহণের পটভূমি
যখন মক্কায় গোপনে নবুওয়তের সূচনা হলো, তখন চারদিকে ধীরে ধীরে ইসলামের খবর ছড়িয়ে পড়ছিল।
আবূ যর (রা.) দূর থেকে শুনলেন যে মক্কায় একজন নবী (মুহাম্মাদ ﷺ) এসেছেন, যিনি মানুষকে এক আল্লাহর উপাসনার দিকে আহ্বান করছেন। তিনি তাঁর ভাই উনাইসকে মক্কায় পাঠালেন খবর সংগ্রহ করতে।
উনাইস গিয়ে ফিরে এসে বলল —
“আমি এমন এক ব্যক্তির সাথে দেখা করেছি, যিনি খুবই সুন্দর কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য কবিতা নয়, ভবিষ্যদ্বাণীও নয়; বরং এটি এক বিশেষ বাণী।”
এতে আবূ যরের মন আরো উদ্দীপ্ত হলো। তিনি বললেন —
“আমি নিজেই গিয়ে এই নবী সম্পর্কে জানব।”
♦️ মক্কায় আগমন
আবূ যর (রা.) একা একা মক্কায় এসে পৌঁছালেন, কিন্তু কাউকে কিছু বলেন নি। তিনি কারও কাছে সাহস করে নবী ﷺ সম্পর্কে জানতে চাইলেন না, কারণ ইসলাম তখন গোপনে প্রচারিত হচ্ছিল। তিনি কাবা শরীফের কাছে অবস্থান করতেন, রাতে সেখানে ঘুমাতেন।
♦️ হযরত আলী (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ
একদিন হযরত আলী ইবন আবি তালিব (রা.) তাঁর দিকে লক্ষ্য করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, তোমাকে অপরিচিত মনে হচ্ছে। কোথা থেকে এসেছো?”
আবূ যর বললেন, “আমি এক যাত্রী, কিছুদিন এখানে থাকব।”
আলী (রা.) তাঁকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন, খাবার দিলেন।
পরদিন আবার একই ঘটনা ঘটল। তৃতীয় দিনের দিন হজরত আলী (রা.) বললেন, “আসলে তুমি কিছু খুঁজছো, তাই না?”
আবূ যর (রা.) বললেন -
“হ্যাঁ, আমি সেই ব্যক্তির সন্ধানে এসেছি যিনি দাবি করেছেন যে তিনি আল্লাহর নবী।”
হজরত আলী (রা.) তখন বললেন -
“তুমি সঠিক পথে এসেছো। তিনি অবশ্যই সত্য নবী। আমি সকালবেলায় তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবো, তবে সাবধানে যেতে হবে।”
♦️ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ
সকালে হযরত আলী (রা.) আবূ জরকে নিয়ে গোপনে নবী করিম ﷺ-এর কাছে নিয়ে গেলেন। যখন নবী ﷺ এর সামনে উপস্থিত হলেন, তখন তিনি বললেন -
“আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ।”
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন —
“তুমি কে?”
আবূ যর (রা.) উত্তর দিলেন —
“আমি গিফার গোত্রের একজন।”
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত পাঠ করে শোনালেন।
শোনামাত্রই তাঁর অন্তর আলোতে ভরে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন —
“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।” তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম গ্রহণ করেন।
♦️ খোলাখুলিভাবে ইসলাম ঘোষণা
হজরত রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে পরামর্শ দিলেন —
“এখন তুমি ফিরে যাও এবং যখন আমাদের ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যে হবে, তখন এসে দেখা করো।”
কিন্তু আবূ যর (রা.) বললেন - “না, আমি এখনই মক্কার কেন্দ্রে গিয়ে ঘোষণা করব যে আমি ঈমান এনেছি।”
তিনি গেলেন মাসজিদুল হারামে (কাবা প্রাঙ্গণে) এবং উচ্চস্বরে ঘোষণা করলেন -
“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ।”
মুশরিকরা শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে তাঁকে আক্রমণ করল এবং মারধর করতে লাগল। একজন সাহসী ব্যক্তি এসে তাঁকে বাঁচালেন, তিনি ছিলেন আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব (রা.), রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চাচা।
আব্বাস (রা.) মুশরিকদের বললেন —
“তোমরা জানো না, এই ব্যক্তি গিফার গোত্রের লোক। তাদের পথ তোমাদের বাণিজ্যপথে পড়ে। যদি তোমরা তাকে হত্যা করো, তোমাদের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে।”
তখন তারা তাঁকে ছেড়ে দেয়।
♦️ ইসলামের প্রচার ও পরবর্তীতে জীবন
এরপর আবূ যর (রা.) নিজ গোত্রে ফিরে যান এবং তাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাঁর দাওয়াতে গিফার গোত্র ও পার্শ্ববর্তী আসলাম গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ পরে শুনে দোয়া করলেন —
“গিফারকে আল্লাহ ক্ষমা করুন এবং আসলামকে শান্তি দিন।” (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩৩২৯)
♦️ বিশেষ বৈশিষ্ট্য -
★ হজরত আবূ যর রাযিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ছিলেন সত্যবাদী, সাদাসিধে ও আল্লাহভীরু।
★ নবী ﷺ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন —
“আকাশের নিচে এবং মাটির উপরে আবূ যরের চেয়ে বেশি সত্যবাদী কেউ নেই।” (তিরমিযী, হাদীস: ৩৮০১)
♦️ মূল সূত্রসমূহঃ-
★ সহীহ বুখারী (হাদীস ৩৩২৯, ৩৫১৯)
★ সহীহ মুসলিম (হাদীস ২৪৭৩)
★ ইবন হিশাম, আস-সীরাতুন নববিয়্যাহ
★ তাবারী, তারীখুল উমাম ওয়াল মুলূক