♦️ পরিচয় -
বেলাল (রাঃ) ছিলেন মক্কায় জন্মগ্রহণকারী একজন দাস; তিনি হাবশী (আফ্রিকান/ইথিওপিয়ান) বংশোদ্ভূত হিসেবে পরিচিত। কুরাইশে তাঁর একজন মালিক ছিলেন, সাধারণত নাম হিসেবে উমাইয়া ইবন খালাফকে (অন্য প্রচলিত রূপে) বর্ণনা করা হয়। হজরত বেলাল রাযিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ছিলেন গান-বিষয়ক অনন্য কণ্ঠশিল্পী; পরে তিনি ইসলামে প্রবেশ করে প্রথম মুয়াযজিন হিসেবে পরিচিত হন।
♦️ নিচে হজরত বেলাল ইবনে রাবাহ আল-হাবশী (রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু)-র ইসলামগ্রহণ ও নির্যাতনের ঘটনার সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিশদ বিবরণ দেওয়া হলো -
♦️ ইসলাম গ্রহণ
প্রাথমিক ইসলামিক বর্ণনায় বলা হয়েছে, বেলাল (রাঃ) মক্কায় ঈমান এনেছিলেন রিসালতের খুব শুরুর সময়ে; তিনি খ্রীষ্টান/হাবশী ঐতিহ্য থেকে আলাদা হয়ে কেবল এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনেন এবং নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী মেনে নেন। ঐতিহাসিক রিসালায় বর্ণিত যে, তিনি সাহসীভাবে তার ঈমান প্রকাশ করতেন যা কুফরীকুলের (মুশরিকদের) ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার কারণ হয়।
♦️ নিষ্ঠুর নির্যাতন (প্রচলিত বিবরণ)
বেলাল (রাঃ)-এর উপর তৎকালীন কাফেররা অত্যন্ত নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে তার ঈমান থেকে ফেরানো। ঐতিহাসিক বর্ণনায় প্রধান ঘটনাগুলো সাধারণত এভাবে বলা হয় -
★ তাঁকে খোলা বেদীতে (গরম বালুকার ওপর) শুইয়ে রাখা হতো।
★ তাঁর উপরে ভারী পাথর বা বড় পাথরের মতো বস্তু চাপিয়ে রাখা হতো যাতে শ্বাসকষ্ট ও যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়।
★ কখনও তাঁকে কঠোর মারধর ও নিপীড়নে রাখা হতো এবং আরেকটু ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধর্মীয় সমঝোতা চাপানো হতো।
★ রাতে তাঁকে চাবুক দিয়ে প্রহার করা হতো, পালাক্রমে একজন একজন করে তাঁকে চাবুকের আঘাত করা হতো, কখনও আবু জাহলের পালা আসতো, কখনও উমাইয়া ইবনে খালফের বেত্রাঘাতের পালা আসতো।
★ পরের দিন সকালে গরম বালুর উপর শুইয়ে রেখে তাঁর ক্ষতস্থানগুলো আরও বেশী ক্ষত-বিক্ষত করা হতো।
★ শাস্তিদাতাগণ শাস্তি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেতো, কিন্তু -
★ এই সব কষ্ট-যন্ত্রণা সত্ত্বেও বেলাল (রাঃ) তাঁর ঈমান ছাড়েননি; ইতিহাসে প্রায়শই তাঁর প্রখর উচ্চস্বরে কণ্ঠে বলে উঠতেন: "আহাদ, আহাদ" (অর্থ "এক" (এক আল্লাহ)") যা তার ঈমানের দৃঢ়তার প্রতীক হিসেবে বর্ণিত। এই কাহিনি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সূত্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
♦️ মুক্তিঃ হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর ভূমিকা
হজরত বেলাল রাযিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর উপর চলা নির্যাতন দেখে ইসলামানুগ লোকজন ও সহমর্মীরা কষ্ট পেতেন। তখন হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাঁকে স্বাভাবিক মূল্যের থেকেও (কাফেরদের দাবীকৃত) বেশী মূল্যে ক্রয় করে মুক্তি দেন, ফলে হজরত বেলাল রাযিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু স্বাধীন হন এবং সরাসরি রাসূলুল্লাহ্ সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সান্নিধ্যে এসে বসবাস শুরু করেন। পরে তিনি মদিনায় হিজরত করেন এবং নবীর (সাঃ) সমীপবর্তী সোসাইটির একজন গুরত্বপূর্ণ সদস্য হন। এই মুক্তিকথা প্রাচীন সীরাত রচনায় সুপ্রচলিত।
♦️ প্রথম মুয়াযজিন হিসেবে নিয়োগ
রাসূলুল্লাহ (সা.) বেলালের কণ্ঠস্বরের স্বরূপ ও আন্তরিক ঈমানকে মূল্য দেন। মসজিদে নামাজের সময় আজানের জন্য একজন নির্দিষ্ট লোক প্রয়োজন হলে বেলালকে সৌন্দর্য এবং গভীর কণ্ঠের কারণে নির্বাচন করা হয়, তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মুগ্ধকর ও দায়িত্বোপযোগী। এভাবে তিনি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সরকারী মুয়াযজিন হিসেবে স্মরণীয়। বহু ঐতিহাসিক উৎসই এটিকে উল্লেখ করে।
♦️ মদিনা-পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু
বহু সূত্র বলে, বেলাল (রাঃ) হিজরত করে নবী (সা.)-র সাথে মদিনায় থাকেন, বিভিন্ন যুদ্ধ/ঘটনায় অংশগ্রহণ করেন এবং পরে শরীয়ত ও খলিফাদের সময়ও সুনামের সঙ্গে জীবন কাটান। শেষপর্যায়ে তিনি শাম (দামাস্কাস) অঞ্চলেই প্রায়ই দায়িত্ব পালন করতেন এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেন, তাঁর কবর দামাস্কাসে (বাব সালঘীর প্রায়) বলে প্রচলিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে মৃত্যুকাল সাধারণত ৬৪০ খ্রি. (১৯ হিজরি)-এর আশেপাশে উল্লেখ আছে।
♦️ ইতিহাস থেকে শিক্ষা -
★ বেলাল (রাঃ)-এর কাহিনি ঈমান-অটলতা, সম্যক সাহস ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানবিক মর্যাদার প্রতীক।
★ তিনি প্রমাণ করলেন—ইসলাম জাতি/বর্ণভেদ ছাড়িয়ে মানুষকে মর্যাদা দেয়; একজন দাস (পরবর্তীকালে মুক্ত) হলেও ঈমান ও কাজের ন্যায়তায় তিনি সমাজে উচ্চ সম্মান পেলেন।
★ তাঁর ‘আহাদ আহাদ’ ও আজানের মধুর কণ্ঠ’ আজও মুসলিম সমাজে শক্তির ও ঐক্যের প্রতীক।