শরীফ ওসমান বিন হাদি, যিনি ওসমান গণি নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও সমাজকর্মী। তিনি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০২৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর তিনি ঢাকার পল্টনে গুপ্তহত্যার শিকার হন এবং ১৮ই ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শিক্ষা:
ওসমান হাদি ১৯৯৩ সালের ৩০শে জুন ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় ইমাম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠা ওসমান হাদি ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
পেশা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সে বিজনেস স্টাডিজ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন।
রাজনীতি:
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের সময় তিনি রামপুরা এলাকার সমন্বয়কারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি ইনকিলাব মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ১৩ই আগস্ট থেকে সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনি আওয়ামী লীগকে সাংবিধানিকভাবে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এবং ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
যেভাবে শহিদ হন:
শরীফ ওসমান হাদির ওপর ২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন এলাকায় একটি পরিকল্পিত সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। সেদিন তিনি একটি মসজিদ থেকে বের হওয়ার পরপরই রিকশায় থাকা অবস্থায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা হামলাকারীরা খুব কাছ থেকে তাঁকে মাথায় গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। হামলার সময় শরীফ ওসমান হাদি আসন্ন ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সক্রিয়ভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। এই হামলার ঘটনায় পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ ও র্যাবের চলমান তদন্তে ফয়সাল করিম মাসুদ ও আলমগীর হোসেন নামের দুইজনকে হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও আন্দোলনকারীদের অভিযোগ অনুযায়ী, ফয়সাল করিম মাসুদ নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মী ছিলেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়। এছাড়া তদন্তে উঠে এসেছে যে, ফয়সালের সঙ্গে আটক প্রত্যেক ব্যক্তিরই এই হামলার আগে ও পরে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। র্যাব এই ঘটনায় ফয়সাল করিম মাসুদের স্ত্রী সামিয়া, তার বন্ধু মনিকা এবং তার শ্যালক শিপুকে আটক করে। পাশাপাশি অভিযোগ রয়েছে, ফয়সালের বাবা-মাও হামলার পর তাকে আত্মগোপনে যেতে ও নিরাপদে পালিয়ে থাকতে সহায়তা করেছিলেন। এ কারণে তদন্তের অংশ হিসেবে তাদেরও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরবর্তীতে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে উন্নত নিউরোসার্জিক্যাল চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল ও ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক দল তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রেখে সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রদান করেন। তবে চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি অপরিবর্তনীয় মস্তিষ্ক ক্ষতি এবং একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার শিকার হন। হামলার ছয় দিন পর, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ সালে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে অপারেশন চলাকালীন অবস্থায়, ৩২ বছর বয়সে শরীফ ওসমান হাদি শাহাদাত বরণ করেন।