সুলতান সুলেমান “দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট” তাঁর এক সময়ের প্রিয় বন্ধু, পরামর্শদাতা ও প্রধানমন্ত্রী (উজিরে আ’জম) পারগালি ইব্রাহিম পাশাকে (Pargalı İbrahim Pasha) নিজ হাতে মৃত্যুদণ্ড দেন। এটি ওসমানীয় ইতিহাসের অন্যতম সবচেয়ে রহস্যময় ও বিতর্কিত ঘটনা।
♦️ ইব্রাহিম পাশা কে ছিলেন?
তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৪৯৩ সালে গ্রীসের পারগা অঞ্চলে (সেখান থেকে নাম পারগালি)। তিনি ছিলেন মূলত এক খ্রিষ্টান বালক, যাকে শৈশবে বন্দি করে দেবশিরমে পদ্ধতিতে ইস্তানবুলে আনা হয়। সেখানে তিনি যুবরাজ সুলেমান (তখনও সুলতান হন নি)-এর ব্যক্তিগত সেবক বা সহচর হিসেবে দায়িত্ব পান।
দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সুলেমান তাঁকে “বন্ধুর চেয়েও প্রিয় ভাই” বলে উল্লেখ করতেন।
♦️ উত্থান
সুলেমান সিংহাসনে বসার পর (১৫২০ সালে) ইব্রাহিম পাশা দ্রুত পদোন্নতি পান —
→ রাজকীয় দেহরক্ষী,
→ চেম্বারলেইন,
→ এবং অবশেষে গ্র্যান্ড ভিজির (উজিরে আ’জম) — ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হন।
তাঁকে সুলতানের বোন হাতিজে সুলতান-এর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানটি এত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল যে, ইতিহাসে একে বলা হয় “সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের বিয়ে”।
♦️ পতনের সূচনা
কিন্তু সাফল্যের শীর্ষে উঠার পর ইব্রাহিম পাশার আচরণে পরিবর্তন আসে, যেমন -
১. অতিরিক্ত আত্মগরিমা ও অহংকার -
তিনি নিজেকে প্রায় সুলতানের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করেন। এমনকি সরকারি নথিতে কখনো নিজের নামের পাশে লিখতেন “সুলতান ইব্রাহিম” (যা সম্রাটের উপাধি!)
২. রাজনৈতিক প্রভাব ও ঈর্ষা -
তাঁর ক্ষমতা এত বেড়ে যায় যে রাজদরবারের অন্য মন্ত্রীরা ও হুররাম সুলতান (সুলেমানের প্রিয়তমা স্ত্রী) তাঁকে ভয় পেতে শুরু করেন। বিশেষ করে হুররাম সুলতান মনে করতেন, ইব্রাহিম পাশা মাহিদেভরান ও তাঁর ছেলে মুস্তফার পক্ষে।
৩. পারস্যের সঙ্গে চুক্তি -
পারস্য (সাফাভিদ সাম্রাজ্য)-এর সঙ্গে তাঁর কিছু কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত সুলতানকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
অনেক ঐতিহাসিক বলেন, তিনি পারস্য শাহের সঙ্গে সমমর্যাদায় চিঠি চালাচালি করতেন, যা ওসমানীয় প্রথা অনুযায়ী অমার্জনীয় অপরাধ ছিল।
♦️ মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা
১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দের এক রাতে, সুলতান সুলেমান তাঁকে রাজপ্রাসাদে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে সুলতানের আদেশে রাত্রিবেলা তাঁবুর ভেতরেই তাঁকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। তাঁর দেহ গোপনে সমাহিত করা হয়।
এই ঘটনার পর সকালে প্রাসাদে ঘোষণা করা হয় যে,
“ইব্রাহিম পাশা আল্লাহর আদেশে মৃত্যুবরণ করেছেন।”
♦️ সম্ভাব্য কারণ (ইতিহাসবিদদের বিশ্লেষণে) -
|
কারণ
|
ব্যাখ্যা
|
|
অহংকার ও স্বৈরতাসুলভ আচরণ
|
নিজেকে সুলতানের সমান ভাবা ও অতিরিক্ত ক্ষমতাচর্চা
|
|
রাজদরবারের ষড়যন্ত্র
|
হুররাম সুলতান ও তাঁর গোষ্ঠীর কূটনীতি
|
|
রাজনৈতিক ভুল
|
পারস্যের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা
|
|
সুলতানের সন্দেহ
|
প্রিয় হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে অবিশ্বস্ত মনে হয়
|
♦️ সুলতানের অনুশোচনা -
ইতিহাসে বর্ণিত আছে, মৃত্যুর পর সুলেমান গভীর অনুশোচনায় ভুগতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “আমি রাজত্ব রক্ষা করলাম, কিন্তু হৃদয়ের বন্ধুকে হারালাম।”