♦️ বাঙলা না বাংলা
"বাঙলা" না "বাংলা"—কোন্ বানানটি শুদ্ধ? আজকালকার পণ্ডিতেরা বলেন, দু'টোই শুদ্ধ। কিন্তু আমরা দেখছি, দুই বানানই সমান চলছে না। আমাদের সব অভিধানের নাম "বাংলা অভিধান"। সংবিধানে দেশের নাম "বাংলাদেশ"। দুই বানানই শুদ্ধ হলে প্রায় সবাই এক বানান কেন লেখে?
এ নিয়ে একসময় আমি কিছু চিন্তা ও অনুসন্ধান করেছিলাম। এ চিন্তা ও অনুসন্ধানের ফলাফল হল—ভাষার নাম বাঙলা, দেশের নাম বাংলা। দীর্ঘকাল ধরে এ নিয়মই আমি মেনে চলছি। ভাষা বুঝাতে লিখছি ‘বাঙলা’, আর দেশ বুঝাতে ‘বাংলা’ বা ‘বাংলাদেশ’।
ভাষিক যুক্তিতে যাওয়ার আগে দু’টো হালকা কথা বলি। অনুস্বার আসলে পূর্ণ কোনো হরফ নয়। না আকারে, না প্রকারে। ‘বাংলা’ শব্দটির দিকে এক মিনিট ধরে তাকিয়ে থাকুন। দু’ পাশে দু’টি মাত্রাঅলা স্বাস্থ্যবান হরফের মাঝখানে ঝুলে আছে মাত্রাহীন ঠিঙঠিঙে ভাঙা ন্যাংটা অনুস্বার। এ তো গেল খণ্ডিত আকারের কথা। প্রকারের দোষ হল—এটা কোনো ‘কারচিহ্ন’ নিতে পারে না। আপনি ‘বাংলা’ অনুস্বার দিয়ে লিখতে পারলেও, ‘বাঙালি’ পারবেন না—চট্ করে চলে আসবে ঙ। রং, কিন্তু রঙিন। এই হল অনুস্বার। অপূর্ণ ও পরাশ্রয়ী একটা হরফ, কিংবা একটা চিহ্ন মাত্র। এজন্যই ধ্বনিতত্ত্ববিদ ও বৈয়াকরণ মুহম্মদ আবদুল হাই প্রস্তাব করেছিলেন, বাঙলা বর্ণমালা সংস্কারের সময় যেন অনুস্বারকে ছাঁটাই করে ফেলা হয়। কারণ এ যা করে, ঙ তা পারে—কিন্তু ঙ যা করে, অনুস্বার তা পারে না।
ভাষিক যুক্তিটা বিখ্যাত বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ও ব্যাকরণবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি তাঁর ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ-এর শুরুর দিকেই ‘বাঙলা’ ও ‘বাংলা’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনার সারকথা হল, ইতিহাসের কোনো কালেই আমাদের ভাষার নামে ও দেশের নামে অনুস্বার ছিল না। আদি শব্দ ‘বঙ্গ’, যা ছিল এ ভূখণ্ডের নাম। তুর্কি শাসনামলে যখন রাজভাষা ফারসি হল, তখন বঙ্গের বাসিন্দা বুঝাতে ‘বঙ্গ’-এর সঙ্গে ‘আল’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে শব্দটি হল ‘বঙ্গাল’। ফারসিতে নামটি লেখা হতে হতে সেই ভাষার স্বভাবের টানে তা কিছুটা বদলে গিয়ে হল ‘বঙ্গালহ’। বাঙালিদের কাছে বিদেশিদের দেওয়া এ নাম স্বীকৃত হল, এবং তাদের মুখে শব্দটির রূপ দাঁড়াল ‘বাঙ্গালা’। কিন্তু তাদের মুখের ভাষায় প্রথম হরফে বল বা ঝোঁকের ফলে দ্বিতীয় হরফটি দুর্বল হয়ে হারিয়ে বসল তার আ-কার। এভাবে তা হয়ে গেল ‘বাঙ্গলা’। তারপর দেখা গেল, যেসব শব্দে 'ঙ্গ' আছে, বাঙালিরা সেসব শব্দের 'গ' উচ্চারণ করে না। ফলে 'গ' গেল হারিয়ে, এবং শেষমেশ শব্দটির চূড়ান্ত দাঁড়াল 'বাঙলা'। কিন্তু ঙ আর অনুস্বারের ধ্বনি এক হওয়ায় কেউ কেউ 'বাঙলা'-কে 'বাংলা' লেখা শুরু করলেন। সুনীতিকুমারের যুক্তিটা হল, 'বাঙাল' ও 'বাঙালি' লিখতে যেহেতু ঙ ছাড়া উপায় নেই, তাই বানানে সমতাবিধানের স্বার্থে সবসময় ঙ দিয়ে "বাঙলা" লেখাই ভালো।
যুক্তিটা শক্ত বৈকি। বিকলাঙ্গ অনুস্বারে তো চলে না আমাদের। 'বাংলা'-কে বিশেষণ করলেই ফিরে আসে সেই ঙ─যে 'বাংলা'য় বলে, 'বাংলা'য় চলে, তাকে আমরা 'বাংালি' তো লিখতে পারি না, লিখি বাঙালি। কাজেই সর্বত্র ঙ ব্যবহার করে "বাঙলা" ও "বাঙালি" লিখলে দ্বৈততা এড়ানো যায়, সমতা আসে বানানে।
কিন্তু কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল অনুস্বার? এর পেছনে আছে মজার এক গল্প। আমরা জানি, ছন্দ ঠিক রাখতে কবি ও গীতিকারেরা মাঝেমধ্যে শব্দের রূপ বদলান। যত্ন-কে লেখেন যতন, রত্ন-কে রতন, লেখেন প্রবেশ করিল-এর স্থলে পশিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ তাঁর তুমি কোন্ কাননের ফুল গানে তারা-এর সঙ্গে অন্ত্যমিল দিতে গিয়ে পার শব্দকে বানিয়ে ফেললেন পারা। তিনি লিখলেন: তোমায় কোথায় দেখেছি, যেন কোন্ স্বপনের পারা। এখানে মিলের খাতিরে যেমন পার হয়েছে পারা, তেমনি তিনি তাঁর আরেকটি গান বাংলার মাটি বাংলার জল-এ ছন্দ রক্ষার্থে 'বাঙ্গলা'-কে একবার 'বাংলা' লিখেছিলেন। হেতু না জেনে এই বানানটাই যে সবাই নির্বিচারে অনুসরণ করতে শুরু করবে, কবি তা ভাবেন নি। তাঁর কৈফিয়ত দেখুন:
আমাদের এই যে দেশকে মুসলমানেরা বাঙ্গালা বলিতেন তাহার নামটি বর্তমানে আমরা কিরূপ বানান করিয়া লিখিব শ্রীযুক্ত বীরেশ্বর সেন মহাশয় [১৩২২] চৈত্রের প্রবাসীতে তার আলোচনা করিয়াছেন।
আমি মনে করি এর জবাবদিহি আমার। কেননা, আমিই প্রথমে বাংলা এই বানান ব্যবহার করিয়াছিলাম।
আমার কোনো কোনো পদ্যরচনার যুক্ত অক্ষরকে যখন দুই মাত্রা হিসাবে গণনা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম তখনই প্রথম বানান সম্বন্ধে আমাকে সতর্ক হইতে হইয়াছিল। "ঙ্গ' অক্ষরটি যুক্ত অক্ষর─ উহার পুরা আওয়াজটি আদায় করিতে হইলে এক মাত্রা ছড়াইয়া যায়। সেটা আমার ছন্দের পক্ষে যদি আবশ্যক হয় তো ভালোই, যদি না হয় তবে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।
এক-একটি অক্ষর প্রধানত এক-একটি আওয়াজের পরিচয়, শব্দতত্ত্বের নহে। সেটা বিশেষ করিয়া অনুভব করা যায় ছন্দরচনায়। শব্দতত্ত্ব অনুসারে লিখিব এক, আর ব্যবহার অনুসারে উচ্চারণ করিব আর, এটা ছন্দ পড়িবার পক্ষে বড়ো অসুবিধা। যেখানে যুক্ত অক্ষরেই ছন্দের আকাঙ্ক্ষা সেখানে যুক্ত অক্ষর লিখিলে পড়িবার সময় পাঠকের কোনো সংশয় থাকে না। যদি লেখা যায়─
বাঙ্গলা দেশে জন্মেছ বলে
বাঙ্গালী নহ তুমি;
সন্তান হইতে সাধনা করিলে
লভিবে জন্মভূমি─
তবে অমি পাঠকের নিকট "ঙ্গ' যুক্ত-অক্ষরের পুরা আওয়াজ দাবি করিব। অর্থাৎ এখানে মাত্রাগণনায় বাঙ্গলা শব্দ হইতে চার মাত্রার হিসাব চাই। কিন্তু যখন লিখিব "বাংলার মাটি বাংলার জল", তখন উক্ত বানানের দ্বারা কবির এই প্রার্থনা প্রকাশ পায় যে 'বাংলা' শব্দের উপর পাঠক যেন তিন মাত্রার অতিরিক্ত নিশ্বাস খরচ না করেন। 'বাঙ্গলার মাটি' যথারীতি পড়িলে এইখানে ছন্দ মাটি হয়।
এই ছিল "বাংলা" বানান ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ। কবির এ কৈফিয়ত যদি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, তাহলে আমাদের উচিত "বাঙলা" লেখা। যদি নিজের কথা বলি, আমি এ কৈফিয়ত গ্রহণ করেছি। সেজন্যই আমি "বাঙলা" লিখি─তবে সে "বাঙলা" দেশ নয়, ভাষা। বাঙলাভাষা। দেশের নামে আমিও, অন্যদের মতোই, "বাংলা" লেখার পক্ষে। নেহাত ঠেকায় পড়ে এ পক্ষপাত। কেননা সংবিধান অনুযায়ী আমাদের দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমি একা চাইলেই তো সংবিধান বদলাতে পারব না। সবাইকেই চাইতে হবে। সেটা যতদিন না ঘটছে, ততদিন অগত্যা "বাংলাদেশ" না লিখে উপায় কী। ব্যক্তির পক্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে দণ্ডলাভের ঝুঁকি মাথায় নেওয়া কি ঠিক হবে!
————————————————————
লিখেছেন - আবদুল হক॥ অগাস্ট ২৬, ২০২৩।