প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে দৈনিক কাজগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই বয়সের শিশুদের শেখানোর জন্য বিশেষ মনোযোগ, সহানুভূতি, এবং পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকের দৈনিক কাজের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্ব থাকে, যেগুলি শিশুর শিক্ষা, বিকাশ এবং ভাল পরিবেশ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। নিচে কিছু সাধারণ দৈনিক কাজের তালিকা দেয়া হলো:
১. শিশুদের অভ্যর্থনা ও সৃজনশীল পরিবেশ তৈরি (Welcoming and Creating a Positive Environment)
শিশুদের অভ্যর্থনা: শিশুরা স্কুলে এসে শিক্ষককে দেখে শান্তি এবং সুরক্ষা অনুভব করতে পারে। তাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানানো এবং তাদের ভালবাসা ও সহানুভূতির সঙ্গে স্বাগত জানানো।
পরিবেশ তৈরি: শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সৃজনশীল, নিরাপদ এবং শিক্ষামূলক পরিবেশ তৈরি করা যাতে তারা নিজেকে মুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারে। শ্রেণীকক্ষে উপকরণ যেমন বই, খেলনা, রঙিন কাগজ, পেন্সিল প্রভৃতি সঠিকভাবে সাজানো থাকে।
২. শিশুদের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি (Physical and Emotional Preparation)
শিশুদের প্রস্তুতি: ক্লাস শুরুর আগে শিশুদের শারীরিক প্রস্তুতি যেমন হাত ধোয়া, বসার সঠিক ভঙ্গি বা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চেক করা।
আবেগিক প্রস্তুতি: শিশুদের মানসিক প্রস্তুতির জন্য সহানুভূতি, শান্তি ও ইতিবাচক মনোভাবের পরিবেশ তৈরি করা, যাতে তারা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী এবং উদ্বিগ্ন না থাকে।
৩. শিক্ষণ পরিকল্পনা (Lesson Planning)
দৈনিক পরিকল্পনা: প্রতিদিনের পাঠ্যক্রম ও কার্যক্রমের জন্য একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা, যাতে শিশুদের শেখানোর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি ও উপকরণ নির্বাচন করা যায়।
প্রবৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ: শিশুদের শেখার অগ্রগতি লক্ষ্য রাখা এবং তাদের প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী পাঠ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা।
৪. শিশুদের সৃজনশীল কার্যক্রম পরিচালনা (Conducting Creative Activities)
খেলা এবং সৃজনশীল কাজ: শিশুদের খেলা, চিত্রাঙ্কন, গান, নাচ, গল্প শোনা ইত্যাদি সৃজনশীল কার্যক্রম পরিচালনা করা। এসব কার্যক্রম তাদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বিকাশে সাহায্য করে।
গল্প বলা এবং নাটক: শিশুদের কাছে গল্প বলার মাধ্যমে তাদের ভাষাগত দক্ষতা বাড়ানো এবং তাদের কল্পনা শক্তি উজ্জীবিত করা।
৫. শিশুদের আচরণ ও সামাজিক দক্ষতা পর্যবেক্ষণ (Observing Behavior and Social Skills)
সামাজিক আচরণ পর্যবেক্ষণ: শিশুদের মধ্যে শেয়ারিং, সঙ্গী তৈরি, একে অপরের সাথে খেলতে উৎসাহিত করা এবং সহানুভূতি শেখানো।
আচরণ পরিচালনা: শ্রেণীকক্ষে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শিশুদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা এবং সমস্যাযুক্ত আচরণ সংশোধন করতে সহায়তা করা।
৬. ভাষাগত এবং গাণিতিক দক্ষতা উন্নয়ন (Language and Cognitive Skills Development)
ভাষাগত দক্ষতা: শিশুদের কথা বলা, শ্রবণ, এবং শব্দভান্ডার উন্নত করার জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা।
গণনা ও সংখ্যা শিখানো: ছোট সংখ্যা বা মৌলিক গণনা শিখানোর জন্য খেলা বা চিত্র ব্যবহার করা।
৭. শিক্ষার্থীদের উন্নতি পর্যালোচনা (Reviewing Student Progress)
প্রকৃতিগত পর্যবেক্ষণ: দৈনিক শিশুর শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক উন্নতি পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে শিক্ষণ পদ্ধতি বদলানো।
ফিডব্যাক দেওয়া: শিশুদের সৃজনশীল কাজ, আচরণ বা শিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফিডব্যাক দেওয়া, যাতে তারা তাদের ভুল শিখতে পারে এবং আরও ভালো করতে অনুপ্রাণিত হয়।
৮. শিক্ষার উৎসাহ বৃদ্ধি (Motivating Students)
সঙ্গী হয়ে উৎসাহ দেওয়া: শিশুদের যে কোনো ছোট সাফল্য বা অগ্রগতি উদযাপন করা এবং তাদের উৎসাহিত করা।
পুরস্কার ও প্রশংসা: শিশুদের সফলতা বা ভালো আচরণের জন্য ছোট ছোট পুরস্কার দেওয়া।
৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা (Cleanliness and Health Awareness)
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: শ্রেণীকক্ষের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, যাতে শিশুদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে।
স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতা: শিশুদের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন করা যেমন হাত ধোয়া, সঠিক পদ্ধতিতে খাবার খাওয়া ইত্যাদি।
১০. পরিবারের সাথে যোগাযোগ (Communication with Parents)
অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ: শিশুদের উন্নতি সম্পর্কে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা। যদি কোনো শিশুর আচরণ বা শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকে, তা নিয়ে অভিভাবকদের অবহিত করা।
মিটিং এবং রিপোর্টিং: শিশুদের সামগ্রিক অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করা এবং অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করা।
১১. বিভিন্ন প্রজেক্ট ও কার্যক্রম পরিকল্পনা (Planning Projects and Activities)
থিম ভিত্তিক কার্যক্রম: শিশুদের জন্য বিভিন্ন শৈল্পিক বা শিখনমূলক প্রকল্প এবং কার্যক্রম পরিকল্পনা করা যেমন সিজনাল বা ঐতিহ্যিক কার্যক্রম।
বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন: বিভিন্ন ছোট ছোট অনুষ্ঠান বা উৎসবের আয়োজন করে তাদের সামাজিক অভিজ্ঞতা বাড়ানো।
১২. শিশুদের মস্তিষ্কের উন্নয়ন এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে কাজ (Cognitive and Psychological Development)
মস্তিষ্কের উন্নয়ন বিষয়ক কার্যক্রম: বিভিন্ন ধাঁধা, মেমরি গেমস, চিন্তাভাবনা বাড়ানোর কাজ করা।
মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা: শিশুরা যদি কোনো মানসিক সমস্যায় থাকে, তাদের সহানুভূতির সঙ্গে সমাধান খোঁজা।
উপসংহার:
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকের কাজ শুধুমাত্র পাঠদান নয়, বরং শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে সহায়তা করা। শিক্ষককে তাদের প্রতিদিনের কাজগুলো পরিকল্পিত এবং শিশুবান্ধব উপায়ে সম্পাদন করতে হবে যাতে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল এবং সমাজিকভাবে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে।