ব্লকচেইন (Blockchain) হলো একটি বিশেষ ধরনের ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার প্রযুক্তি (Distributed Ledger Technology, DLT) যা ডেটা সংরক্ষণ, যাচাই এবং পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি এমন একটি বিকেন্দ্রীকৃত (Decentralized) সিস্টেম যেখানে কোনো একক কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। প্রতিটি ডেটা ব্লক আকারে সংরক্ষিত হয় এবং একটির সঙ্গে আরেকটি ক্রিপ্টোগ্রাফি (Cryptography) দ্বারা সংযুক্ত থাকে, যা ব্লকগুলোর মধ্যে একটি চেইন তৈরি করে।
প্রথমে ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, তবে বর্তমানে এটি আর্থিক খাত ছাড়িয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সুযোগ করে দিচ্ছে।
ব্লকচেইনের মূল উপাদান
ব্লকচেইনের প্রতিটি অংশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যা প্রযুক্তিটিকে নির্ভুলভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। এর কিছু প্রধান উপাদান হলো:
-
ব্লক (Block):
ব্লক হলো একটি প্যাকেটের মতো, যেখানে বিভিন্ন ডেটা জমা হয়। প্রতিটি ব্লক তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত:
-
ডেটা (Data): লেনদেন বা সংরক্ষণযোগ্য তথ্য।
-
হ্যাশ (Hash): প্রতিটি ব্লকের জন্য একটি অনন্য ডিজিটাল সিগনেচার, যা পরিবর্তনের সম্ভাবনা কমায়।
-
পূর্ববর্তী ব্লকের হ্যাশ (Previous Block's Hash): এটি বর্তমান ব্লককে পূর্ববর্তী ব্লকের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
-
ডিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্ক (Distributed Network):
ব্লকচেইন একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেখানে নোড (Nodes) নামক ব্যবহারকারীরা সক্রিয় থাকে। প্রতিটি নোড একই কপি বা সংস্করণ ধারণ করে।
-
মাইনিং (Mining):
ব্লকচেইনে নতুন ব্লক যোগ করার প্রক্রিয়াকে মাইনিং বলা হয়। মাইনাররা জটিল গণিত সমস্যার সমাধান করে ব্লক তৈরি করে এবং পুরস্কার হিসেবে ক্রিপ্টোকারেন্সি পায়।
ব্লকচেইন কীভাবে কাজ করে?
ব্লকচেইনের কাজের ধাপগুলো হলো:
১. লেনদেনের অনুরোধ
যখন কেউ একটি লেনদেন শুরু করে (যেমন, বিটকয়েন পাঠানো), তখন সেই লেনদেনটি একটি ব্লক হিসেবে তৈরি হয়।
২. লেনদেন যাচাই
নেটওয়ার্কে থাকা নোডগুলো লেনদেনের বৈধতা যাচাই করে। এটি করতে তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
৩. ব্লক চেইনে যোগ করা
যাচাই করা লেনদেন সফল হলে একটি নতুন ব্লক তৈরি হয় এবং সেটি পূর্ববর্তী ব্লকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
৪. ব্লকের নিরাপত্তা
প্রতিটি ব্লক ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ব্যবহার করে সুরক্ষিত থাকে, যা পরিবর্তনের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য করে।
ব্লকচেইনের বৈশিষ্ট্য
-
বিকেন্দ্রীকৃত (Decentralized):
কোনো একক নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ছাড়া এটি কাজ করে। প্রতিটি অংশগ্রহণকারী নোড সমান ক্ষমতা রাখে।
-
নিরাপত্তা (Security):
ব্লকচেইনের প্রতিটি ব্লক একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক কৌশল ব্যবহার করে সুরক্ষিত। একবার তথ্য যোগ করা হলে তা পরিবর্তন করা অত্যন্ত কঠিন।
-
স্বচ্ছতা (Transparency):
ব্লকচেইনের প্রতিটি লেনদেন নেটওয়ার্কের অংশগ্রহণকারীদের জন্য দৃশ্যমান।
-
পরিবর্তন অযোগ্যতা (Immutability):
একবার ডেটা যুক্ত হয়ে গেলে তা সংশোধন বা মুছতে পারা যায় না।
ব্লকচেইনের ব্যবহার ক্ষেত্র
ব্লকচেইন প্রযুক্তি শুধু আর্থিক খাতেই নয়, বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন:
-
ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency):
বিটকয়েন, ইথেরিয়ামের মতো ডিজিটাল মুদ্রা ব্লকচেইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
-
স্মার্ট কন্ট্রাক্ট (Smart Contract):
এটি এমন একটি ডিজিটাল চুক্তি যা নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
-
সরবরাহ শৃঙ্খল (Supply Chain):
পণ্যের উৎস এবং সরবরাহের প্রতিটি ধাপ নির্ভুলভাবে নজরদারি করা যায়।
-
ডিজিটাল ভোটিং (Digital Voting):
ব্লকচেইন ভিত্তিক ভোটিং ব্যবস্থা স্বচ্ছতা ও জালিয়াতি প্রতিরোধ করে।