হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তায়েফ সফর ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এবং শিক্ষণীয় একটি অধ্যায়। নিচে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—
♦️ প্রেক্ষাপট -
নবী করিম ﷺ যখন মক্কায় ১০ বছর ধরে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করলেন, তখন কুরাইশরা ইসলাম গ্রহণ তো দূরের কথা, বরং তাঁকে নির্যাতন ও অবমাননা করতে থাকে।
এই সময়েই তাঁর জীবনে দুটি গভীর দুঃখজনক ঘটনা ঘটে।
1. চাচা আবু তালিব, যিনি তাঁকে সবসময় কুরাইশদের ঝুট-ঝামেলা ও বিপদাপদ থেকে রক্ষা করতেন, তিনি ইন্তিকাল করেন।
2. প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা, যিনি মানসিক ও আর্থিকভাবে সবসময় পাশে ছিলেন, তিনিও ইন্তিকাল করেন।
♦️ এজন্য এই দুই প্রিয়জনের মৃত্যুর বছরটিকে বলা হয় -
"عامُ الحُزن" (আমুল হুযন) — অর্থাৎ “দুঃখের বছর”।
♦️ তায়েফ সফরের সিদ্ধান্ত
মক্কার মানুষ যখন ইসলাম গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করল, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ ভাবলেন, “হয়তো তায়েফের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে।” তাই তিনি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তায়েফে গেলেন। তিনি অবশ্য একা যান নি, সাথে ছিলেন তাঁর দাস ও সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রাঃ)।
♦️ তায়েফে আগমন ও দাওয়াত
তায়েফে পৌঁছে নবী ﷺ বনু সাকীফ গোত্রের তিনজন প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তারা হলেন -
1. আবদে ইয়ালায়ল
2. মাসঊদ
3. হাবীব
তিনি তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং বলেন, “তোমরা যদি ইসলাম গ্রহণ করো, হয়তো আল্লাহ তোমাদের মাধ্যমে তোমাদের জাতির কল্যাণ ঘটাবেন।”
কিন্তু তারা তাঁকে গ্রহণ তো করলই না, বরং অত্যন্ত অসভ্য ও অবমাননাকর আচরণ করল।
★ তাদের একজন বলল -
“ওহো! আল্লাহ তোমাকে ছাড়া কাউকে রাসূল হিসেবে পাঠাতে পারলেন না?”
★ আরেকজন বলল -
“যদি তুমি সত্যিই নবী হও, তাহলে তোমার সঙ্গে কথা বলা আমার জন্য বিপজ্জনক।”
★ তৃতীয়জন বলল -
“আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না, হয়তো তুমি মিথ্যাবাদী!”
♦️ তায়েফবাসীর নির্যাতন
তারা শুধু উপহাসই করেনি, বরং শহরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের একত্র করে নবী ﷺ-কে গালাগালি ও পাথর মারতে লাগল। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও যায়েদ (রাঃ) দৌড়ে এক বাগানে গিয়ে আশ্রয় নেন। রক্তে তাঁর জুতো ভিজে যায়।
♦️ বাগানে আশ্রয় ও দোয়া
সেই বাগানটি ছিল উতবা ও শায়বা, দুই মুশরিক ভাইয়ের। তারা দূর থেকে এই অবস্থা দেখে “আদ্দাস” নামের একজন খ্রিস্টান দাসকে ডেকে কিছু আঙুর পাঠায়।
নবী ﷺ যখন আঙুর নিতে গিয়ে বললেন — “بِسْمِ اللَّهِ” (বিসমিল্লাহ), তখন আদ্দাস অবাক হয়ে বলল - “এ কথা তো এই অঞ্চলের লোকেরা বলে না!” তখন নবী ﷺ জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোন দেশ ও জাতির লোক?” আদ্দাস বলল, “আমি নিনাওয়া অঞ্চলের।”
নবী ﷺ বললেন - “ওহ, ইউনুস ইবনে মাত্তা নবীর শহর!” আদ্দাস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি ইউনুসকে কীভাবে জানেন?” নবী ﷺ বললেন - “তিনি আমার ভাই ছিলেন; আমিও আল্লাহর নবী।”
এ কথা শুনে আদ্দাস নবী ﷺ-এর হাত ও পা চুমু দিয়ে বলল - “এই মানুষ মিথ্যাবাদী হতে পারেন না।”
♦️ নবী করিম ﷺ-এর দোয়া
তায়েফের নির্যাতনের পর নবী ﷺ মাথা আকাশের দিকে তুলে আল্লাহর দরবারে এক গভীর দোয়া করেন-
♦️ দো‘আয়ে তায়েফ (دعاء الطائف)
اللَّهُمَّ إِلَيْكَ أَشْكُو ضَعْفَ قُوَّتِي، وَقِلَّةَ حِيلَتِي، وَهَوَانِي عَلَى النَّاسِ،
يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ، أَنْتَ رَبُّ الْمُسْتَضْعَفِينَ، وَأَنْتَ رَبِّي،
إِلَى مَنْ تَكِلُنِي؟
إِلَى بَعِيدٍ يَتَجَهَّمُنِي، أَمْ إِلَى عَدُوٍّ مَلَّكْتَهُ أَمْرِي؟
إِنْ لَمْ يَكُنْ بِكَ عَلَيَّ غَضَبٌ فَلَا أُبَالِي،
وَلَكِنَّ عَافِيَتَكَ هِيَ أَوْسَعُ لِي،
أَعُوذُ بِنُورِ وَجْهِكَ الَّذِي أَشْرَقَتْ لَهُ الظُّلُمَاتُ،
وَصَلَحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ،
مِنْ أَنْ تَنْزِلَ بِي غَضَبَكَ، أَوْ يَحِلَّ عَلَيَّ سَخَطُكَ،
لَكَ الْعُتْبَى حَتَّى تَرْضَى،
وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِكَ.
(ইবন হিশাম, সীরাতুন নবী)
এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অত্যন্ত আবেগপূর্ণ, বিনয়পূর্ণ এবং তাওয়াক্কুলভিত্তিক দো’আ।
♦️ ফেরার পথে ও ফেরেশতার প্রস্তাব
ফেরার পথে নবী ﷺ-কে জিবরাইল (আঃ) এসে বলেন - “হে মুহাম্মদ ﷺ, আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। যদি তুমি চাও, আমি তায়েফের এই দুই পাহাড়ের মাঝখানে থাকা মানুষদের চূর্ণ করে ফেলি।” কিন্তু নবী ﷺ বললেন, “না, আমি বরং আশা করি তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন মানুষ জন্মাবে যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে।”
এই ছিল তাঁর অশেষ দয়া ও ক্ষমাশীলতার নিদর্শন।
♦️ ফলাফল ও শিক্ষা
তায়েফ সফর থেকে নবী ﷺ তাৎক্ষণিক কোনো সাফল্য পাননি, কিন্তু পরবর্তীতে তায়েফের মানুষই ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
এই সফর আমাদের শেখায় —
1. দাওয়াতের পথে ধৈর্য ও সহনশীলতা অপরিহার্য।
2. অপমানেও দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনই নববী চরিত্র।
3. দুঃখের পরেই আল্লাহ তায়ালা বিজয় দান করেন।