একুশে ফেব্রুয়ারি (২১ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গৌরবময় দিন, যা মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত। এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত হয়। এর প্রেক্ষাপট এবং মর্যাদা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়।
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট:
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তখন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এর মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত পার্থক্য ছিল। বিশেষত, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ছিল ব্যাপক, এবং তারা নিজেদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানাতে থাকে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং সাধারণ মানুষ উর্দুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। তারা তাদের মাতৃভাষা বাংলা কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে মিছিল করেন। এই আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ গুলি চালায় এবং অনেক ছাত্র নিহত হন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই শহীদ হন, বিশেষ করে সালেহ আহমদ, অন্না সুলতান, রফিকুল ইসলাম, বাচ্চু খাঁ প্রমুখ। এই রক্তাক্ত দিনটি বাংলাভাষী মানুষের ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রামের চিহ্ন হয়ে ওঠে।
একুশে ফেব্রুয়ারির মর্যাদা:
১. মাতৃভাষার প্রতি সম্মান: একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানকে চিহ্নিত করে। এ দিনটি শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, বরং পৃথিবীর সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের জন্য একটি প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।
2. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে মাতৃভাষার গুরুত্ব এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান প্রকাশ করা হয়।
3. জাতীয় চেতনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: একুশে ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র ভাষার আন্দোলনের দিন নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও। এটি বাঙালি জাতির জাতীয় চেতনা, আত্মসম্মান এবং স্বাধীনতার প্রতি একটি মাইলফলক ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
4. মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে সংগ্রাম: একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রাম ছিল ভাষার অধিকার রক্ষার, যা পরবর্তীতে মানবাধিকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে পৃথিবীজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। মাতৃভাষার প্রতি সম্মান এবং ভাষাগত অধিকার মানবাধিকার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
5. বিশ্বজনীন মূল্যবোধের প্রতীক: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ভাষা, সংস্কৃতি এবং শিক্ষার সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য উদযাপিত হয়। এটি বিশ্বের সমস্ত জাতি, জাতিগত গোষ্ঠী ও ভাষাভাষীদের জন্য এক সমতার বার্তা প্রদান করে।
উপসংহার:
একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন নয়, এটি পৃথিবীজুড়ে ভাষা এবং সংস্কৃতির অধিকার রক্ষার একটি বৈশ্বিক সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এর স্বীকৃতি পৃথিবীজুড়ে ভাষাগত বৈচিত্র্য ও সম্মান প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় পদক্ষেপ।