ইন্টারফেরন হচ্ছে কোষ থেকে নিঃসৃত একধরণের সাইটোকাইন প্রোটিন যা মানবদেহে ভাইরাস সংক্রমণ সরাসরি প্রতিরোধ করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রন করে। আমাদের শরীরের ইনেট ইমিউন সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি প্রাথমিক রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থা যা যে কোন নতুন জীবানুর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। যেহেতু করোনাভাইরাস একদম নতুন একটি জীবানু তাই এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ইনেট ইমিউনিটি অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক ধরনের ইন্টারফেরন রয়েছে। তার ভেতরে ফুসফুসের ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে টাইপ-১ ইন্টারফেরন প্রোটিন যেমন, ইন্টারফেরন-বিটা প্রধান ভূমিকা পালন করে। ল্যাবরেটরী গবেষণায় দেখা গেছে যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ফুসফুসের কোষের ইন্টারফেরন-বিটা নিঃসরণের পরিমান মারাত্মক ভাবে কমিয়ে দেয়। এছাড়াও ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে দেখা গেছে যে সিভিয়ার কোভিডে যারা আক্রান্ত তাদের রক্তে এই ইন্টারফেরন-বিটার পরিমান খুবই কম। এইসব ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা ধারনা করছিলেন যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হলে বাইরে থেকে কৃত্রিম ভাবে তৈরী ইন্টারফেরন-বিটা ফুসফুসে ইনহেলারের মাধ্যমে সরবরাহ করলে হয়ত ফুসফুসে ভাইরাস সংক্রমণ অনেকাংশেই দমন করা সম্ভব। সম্প্রতি এমনটিই করেছেন ব্রিটেনের একদল গবেষক। তারা ১০০ জন কোভিড-১৯ রোগীর উপর একটা ফেইজ-২ রেন্ডোমাইজড ডাবল ব্লাইন্ড প্ল্যাসিবো-কন্ট্রোল্ড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়েছে। রোগীদের গড় বয়স ছিল ৫৭ বছর এবং সবাই ভর্তি ছিল বিভিন্ন হাসপাতালে, যাদের ভেতর প্রায় ৬৭ শতাংশ রোগীর বাড়তি অক্সিজেন থেরাপী লেগেছিল ট্রায়ালের শুরুতে। তবে আইসিইউতে ভর্তি বা ভেন্টিলেটরে থাকা কোন কোভিড রোগীকে এই ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ট্রায়ালে অংশগ্রহনকারী রোগীদের অর্ধেককে নেবুলাইজারের মাধ্যমে ইন্টারফেরন-বিটা দেয়া হয়েছিল দৈনিক একবার (6 MIU) এবং বাকী অর্ধেককে দেয়া হয়েছিল প্ল্যাসিবো, যার ভেতরে কোন ইন্টারফেরন ছিল না। এভাবে চিকিৎসা দেয়া হয় মোট ১৪ দিন, এবং এরপর ২৮ দিন পর্যন্ত রোগীদের স্বাস্থের উন্নতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে চিকিৎসার ১৫ দিন পর ইন্টারফেরন দেয়াতে শারীরিক উন্নতির হার প্ল্যাসিবো গ্রহিতাদের চেয়ে ২ গুন বেশী। আর ২৮ দিন পর ইন্টারফেরন গ্রহিতাদের ভেতরে এই শারীরিক উন্নতি বা সুস্থ্য হয়ে ওঠার হার বেড়ে দাঁড়ায় তিন গুনেরও বেশী। ইন্টারফেরন না পাওয়া রোগীদের ভেতর তিন জন মারা গেলেও ইন্টারফেরন গ্রহিতাদের ভেতরে কেও মারা যায়নি। এছাড়া ইন্টারফেরন থেরাপি রোগীদের ভেতর সিভিয়ার কোভিড হওয়ার প্রবনতা কমিয়ে ফেলে ৭৯ শতাংশ। এই ট্রায়ালে ইন্টারফেরনের তেমন কোন পার্শ্বপ্রতিক্র িয়াও পরিলক্ষিত হয়নি। গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১২ নভেম্বর ২০২০ ল্যানসেট রেসপিরেটরি মেডিসিন জার্নালে। আশানুরূপ ফলাফল প্রাপ্তির পর গবেষক দলটি এখন বৃহৎ পরিসরে ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানের পরিকল্পনা করছে। কারন, হাজার রোগীর উপরে পরীক্ষা করা ছাড়া কোভিডে ইন্টারফেরনের কার্যকারীতা নিশ্চিত হওয়া যাবেনা। এছাড়াও ইন্টারফেরন-বিটা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ সাবধানতা অবলম্বন করাও বেশ জরুরী। রোগের সঠিক সময় ওষুধটি প্রয়োগ না করলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। যেমন, সিভিয়ার কোভিডে যখন সাইটোকাইন স্ট্রোর্ম চলে তখন যদি ইন্টারফেরন-বিটা প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা সাইটোকাইন স্ট্রোর্মের তিব্রতা আরো বাড়িয়ে দেবে। এতে কোভিডের জটিলতা আরো বেড়ে যাবে। তবে আশা করা যায়, ইন্টারফেরন নেবুলাইজারের ফেইজ-৩ ট্রায়ালের ফলাফল ভাল হলে এই ওষুধটি হতে পারে একটি গেইম চেন্জার! চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইন্টারফেরন-বিটা এক ধরনের রিকম্বিনেন্ট প্রোটিন যার উৎপাদন খরচ মনোক্লোনাল এন্টিবডির উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেকগুন কম। সেক্ষেত্রে, কোভিডে ইন্টারফেরন থেরাপী মনোক্লোনাল এন্টিবডি থেরাপীর চেয়ে হবে অনেকগুন সাশ্রয়ী।