নবাব সিরাজউদ্দৌলার আপন ছোট ভাই মির্জা মেহেদী মীরজাফরের ছেলে মীরনের হাতে নিহত হন। ঘটনার বিবরণ এই -
মির্জা মেহেদীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড: বাংলার নবাবি ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়!
পলাশীর পরাজয় শুধু সিরাজউদ্দৌলার পতনই ডেকে আনেনি—সঙ্গে এনেছিল ভয়ের, প্রতিহিংসার এবং নির্মম নিষ্ঠুরতার এক দীর্ঘ ছায়া। বাংলার ক্ষমতার আসনে বসে মীরজাফরের মনে তখন একটাই ভয়—সিরাজের রক্তধারা বহনকারী কেউ যদি আবার সিংহাসনের দিকে হাত বাড়ায়? এই আতঙ্ক দিন দিন তার অন্তরে এমনভাবে গ্রাস করছিল যে তিনি সন্দেহ করতে লাগলেন প্রতিটি মানুষকে, প্রতিটি সম্ভাবনাকে।
এই সন্দেহের কেন্দ্রে ছিলেন এক কিশোর—মির্জা মেহেদী। সিরাজউদ্দৌলার আপন ছোট ভাই। রক্তে সিরাজের সাহস, চোখে নবাবি পরিবারের গাম্ভীর্য। পলাশীর পর মুর্শিদাবাদে বন্দী হয়ে নিঃসঙ্গ, নিরুপায় জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি।
রায়দুর্লভ মির্জা মেহেদীর মুক্তির জন্য নীরবে চেষ্টা শুরু করলে মীরজাফরের সন্দেহ আরও তীব্র হয়। তার চোখে তখন যে কে সেই—যে কেউ সিরাজের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত, সে-ই সম্ভাব্য শত্রু। মীরজাফরের মনোলোকে যেন একটি ভয়াবহ ধারণা শেকড় গাড়ে—
“সিংহাসন টিকিয়ে রাখতে হলে সিরাজের রক্তধারা বিলোপ করতেই হবে।”
বিহারে যাত্রার আগে মীরজাফর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মীরণকে গোপনে নির্দেশ দিলেন— “মেহেদী যেন বেঁচে না থাকে।”
মীরণ ছিলেন কঠোর, নির্দয়, এবং ক্ষমতা রক্ষার নামে যে কোনো অপরাধে প্রস্তুত। পিতার নির্দেশ শুনে তাঁর মনোস্তাপের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। বরং তিনি এক অদ্ভুত উৎসাহে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি জানতেন—সিরাজের পরিবার যতদিন বেঁচে, ততদিন মীরজাফরের সিংহাসন নিরাপদ নয়।
মীরণের সৈন্যরা একদিন মির্জা মেহেদীকে গ্রেপ্তার করে। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন—যে বাংলায় একদিন তাঁর ভাই নবাব ছিলেন, সেই বাংলায় আজ তাঁর বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও নেই। মেহেদী তখন কিশোর—তরুণ বয়সের অগ্নি তখনো তাঁর রক্তে দাউদাউ করে ওঠেনি। কিন্তু তাঁর অপরাধ ছিল একটাই—তিনি সিরাজের ভাই।
ইতিহাসবিদদের বিবরণে এই হত্যাকাণ্ডের কথা পড়লেই আজও শরীর শিউরে ওঠে। মীরণের আদেশে মির্জা মেহেদীকে দুইটি কাষ্ঠফলকের মাঝে শুইয়ে ফেলা হয়। এরপর সৈন্যরা সেই ফলক দুটি এমন শক্তিতে চেপে ধরে যে— মেহেদীর অস্থি পর্যন্ত ভেঙে যায়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়, এবং মুহূর্তের মধ্যে রাজপরিবারের এক নিরপরাধ সদস্য নির্মম যন্ত্রণার মাঝে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এই নৃশংসতা শুধু একজন কিশোরের শরীরকেই ভেঙে দেয়নি, ভেঙে দিয়েছিল একটি রাজবংশের শেষ আশা, ভেঙে দিয়েছিল বাংলার মানুষের হৃদয়। মির্জা মেহেদীর মৃত্যুর খবর যখন মুর্শিদাবাদের পথে পথে ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ হতভম্ব হয়ে যায়। যে শহর একদিন নবাবদের শৌর্য, শিল্প, সংগীত আর ঐশ্বর্যের জন্য গর্ব করত, সেই শহর আজ দেখল—শাসনক্ষমতার লোভে একটি নিষ্পাপ প্রাণ কীভাবে পশুর মতো হত্যা করা হয়।
লোকমুখে বলা হয়— মেহেদীর মর্মান্তিক মৃত্যুর রাতে হাজারো মানুষ কান্না থামাতে পারেনি। মসজিদের বারান্দায়, খাদিমদের ঘরে, বাজারের দোকানে—সর্বত্র শোকের সুর। যেন শহর নিজেই কেঁদে উঠেছিল এক হারিয়ে যাওয়া রাজবংশের ভবিষ্যৎকে স্মরণ করে।
মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু খুব কম মানুষ জানেন তাঁর পুত্র মীরণের হাতে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ ঘটনাটি— যা বাংলার ইতিহাসে চরম নিষ্ঠুরতা ও ক্ষমতার অন্ধ লোভের এক নির্মম দৃষ্টান্ত। মির্জা মেহেদীর মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়— এটি ছিল নবাবি বাংলার শেষ শিখা নিভে যাওয়ার প্রতীক।