বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈধতা না থাকার পেছনে নানা আইনি, অর্থনৈতিক, এবং প্রাতিষ্ঠানিক কারণ রয়েছে। নিচে এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:
১. আইনগত বাধা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সাল থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে সতর্কতা জারি করে আসছে। ২০১৭ এবং ২০২১ সালে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত নয়, তাই এটি বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৪৭), মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন (২০১২), এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন (২০০৯) লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে, নামবিহীন লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচার বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের সম্ভাবনা আইনগত উদ্বেগের মূল কারণ। যদিও ক্রিপ্টোকে সরাসরি "নিষিদ্ধ" করা হয়নি, তবে বিদ্যমান আইনের আওতায় এর ব্যবহারকে অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২. অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও নজরদারির সীমাবদ্ধতা
ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল বৈশিষ্ট্য যেমন বিকেন্দ্রীকরণ এবং লেনদেনের গোপনীয়তা বাংলাদেশের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে একটি প্রতারণামূলক অ্যাপের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় ক্রিপ্টো ব্যবহারের ঝুঁকি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ক্রিপ্টো লেনদেন মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এছাড়া, কর্তৃপক্ষের পক্ষে ব্যক্তিগত লেনদেন ট্র্যাক করা কঠিন হওয়ায় অবৈধ কার্যক্রম বেড়েছে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির অভাব
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও নীতিমালার ঘাটতি রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রিপ্টো ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নীতির অভাব এবং স্থানীয়ভাবে আইনি প্রস্তুতির অপর্যাপ্ততা এটিকে বৈধতা দেওয়ার পথে বাধা। এছাড়া, ক্রিপ্টোর জটিল প্রযুক্তিগত দিক এবং বিনিয়োগকারীদের প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনাও উদ্বেগ বাড়ায়।
৪. বৈশ্বিক প্রবণতা ও ভবিষ্যৎ বিবেচনা
বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও ক্রিপ্টো নিয়ে গবেষণা বা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেয়নি, যদিও বিশ্বের অনেক দেশ এটিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে বৈধতা না দিলেও ক্রিপ্টোর পর্যবেক্ষণ এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ও চীন নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে পরীক্ষা করলেও বাংলাদেশ এ বিষয়ে পিছিয়ে।
৫. সামাজিক ও সচেতনতার চ্যালেঞ্জ
অনেক ব্যবহারকারী ক্রিপ্টোকারেন্সির আইনি জটিলতা বুঝতে পারেন না এবং লোভে পড়ে প্রতারণার শিকার হন। ২০২৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ক্রিপ্টো ব্যবহারকারীরা আইনের অস্পষ্টতা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্ব্যর্থক ভূমিকার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। সচেতনতা অভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে সাধারণ মানুষ ক্রিপ্টোর সম্ভাব্য ক্ষতি সম্পর্কে অজ্ঞ।
বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈধতা না পাওয়ার মূল কারণ হলো আইনি অনিশ্চয়তা, আর্থিক ঝুঁকি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার ভয়। তবে বৈশ্বিক প্রবণতা ও ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশের সাথে তাল মেলাতে হলে ক্রিপ্টো নিয়ে গবেষণা, নীতিনির্ধারণ, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।