কৃষির ইতিহাস শুরু হয়েছিল প্রায় ১০,০০০ বছর আগে, যখন মানুষ খাদ্যের জন্য শিকার ও ফলমূল সংগ্রহের জীবনযাত্রা থেকে স্থায়ীভাবে ফসল চাষ ও পশুপালনের দিকে অগ্রসর হয়। এটি ছিল মানুষের ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যা নব্যপ্রস্তর যুগে (Neolithic Period) ঘটেছিল। এই পরিবর্তনের ফলে সমাজে স্থায়িত্ব আসে এবং সভ্যতার ভিত্তি গড়ে ওঠে।
কৃষির সূচনা ও প্রাথমিক ইতিহাস:
১. শিকার ও সংগৃহীত খাদ্যের যুগ (Pre-Agricultural Era):
-
প্রাচীনকালে মানুষ মূলত শিকার ও সংগৃহীত খাদ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।
-
তারা ফলমূল, শাকসবজি, শস্যবীজ এবং প্রাণীর মাংস সংগ্রহ করত।
-
স্থায়ী বসবাস ছিল না; খাদ্যের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত।
২. কৃষির সূচনা (Agricultural Revolution):
-
প্রায় ১০,০০০ বছর আগে, মানুষ উপলব্ধি করে যে বীজ মাটিতে পুঁতে দিলে তা থেকে নতুন গাছ জন্মায়। এই পর্যায়ে তারা ধীরে ধীরে ফসল চাষ শুরু করে।
-
প্রথম চাষ করা ফসল ছিল গম, যব, ধান, মসুর এবং বার্লি।
-
পশুদের গৃহপালিত করে দুধ, মাংস, এবং পরিবহন কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়।
৩. স্থায়ী বসবাস:
-
কৃষির ফলে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে, যা স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়।
-
মানুষ গ্রাম গঠন করে এবং একটি সংগঠিত সমাজ তৈরি করতে শুরু করে।
-
কৃষি সমাজে স্থায়িত্ব আনয়ন করে এবং সভ্যতার বিকাশে সহায়তা করে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষির সূচনা:
১. মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia):
-
মেসোপটেমিয়াকে "কৃষির সূতিকাগার" বলা হয়।
-
টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীরে প্রথম ফসল চাষ শুরু হয়।
-
সেচ পদ্ধতির উদ্ভব হয়, যা কৃষিকে আরও উন্নত করে।
২. মিশর (Egypt):
-
নীল নদের তীরে কৃষি উন্নত হয়।
-
সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন শুরু হয়, যা স্থায়ী গ্রাম ও শহরের গঠনকে প্রভাবিত করে।
৩. দক্ষিণ এশিয়া:
-
সিন্ধু সভ্যতায় (বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের অংশ) ধান এবং গম চাষ শুরু হয়।
-
কৃষি এবং পশুপালন একসঙ্গে সমাজ গঠনের ভিত্তি তৈরি করে।
৪. চীন:
-
হলুদ নদীর (Yellow River) অববাহিকায় ধান এবং সরিষা চাষ শুরু হয়।
-
কৃষি এ অঞ্চলের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ হয়ে ওঠে।
৫. আমেরিকা:
-
মায়া, ইনকা এবং অ্যাজটেক সভ্যতায় ভুট্টা, আলু এবং মটরশুঁটি চাষের প্রচলন ঘটে।
কৃষির উন্নয়ন এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন:
১. কৃষি বিপ্লব (Neolithic Revolution):
-
মানুষ খাদ্যের জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভর না করে নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করতে শুরু করে।
-
গৃহপালিত পশু এবং ফসল চাষের মাধ্যমে খাদ্য সংকট কমে।
২. সেচ ব্যবস্থা:
-
নদী থেকে জল সরবরাহ করে শুকনো জমিতে ফসল উৎপাদন শুরু হয়।
-
মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং সিন্ধু সভ্যতায় সেচ ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়।
৩. শস্যচক্র এবং মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ:
-
মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে শস্যচক্রের পদ্ধতি শুরু হয়।
-
বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসল চাষের মাধ্যমে মাটি শক্তিশালী রাখা হতো।
৪. পশুপালন:
-
গৃহপালিত পশু যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, এবং ঘোড়া পালন শুরু হয়।
-
এই পশু খাদ্য, দুধ এবং শ্রমে সাহায্য করত।
উপসংহার:
কৃষির ইতিহাসের সূচনা মানুষকে শিকার ও সংগৃহীত খাদ্য সংগ্রহের জীবনযাত্রা থেকে স্থায়ী এবং সংগঠিত সমাজ গঠনের দিকে নিয়ে যায়। ফসল চাষ এবং পশুপালনের ফলে খাদ্যের প্রাচুর্য তৈরি হয়, যা মানব সভ্যতার বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। কৃষির এই প্রাথমিক বিকাশই পরবর্তী সময়ে শহর, রাজ্য এবং উন্নত সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে।