রক্তের গ্রুপ কীভাবে নির্ধারিত হয়?
রক্তের গ্রুপ নির্ধারিত হয় আমাদের রক্তের রেড ব্লাড সেল (RBC) এর উপর থাকা বিশেষ ধরনের অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি এর সংমিশ্রণ দ্বারা। মূলত দুটি প্রধান সিস্টেমে (অ্যাবো সিস্টেম এবং রেজাস সিস্টেম) রক্তের গ্রুপ শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।
১. অ্যাবো সিস্টেম:
অ্যাবো সিস্টেমের মধ্যে চারটি প্রধান রক্তের গ্রুপ রয়েছে:
-
A গ্রুপ: এই গ্রুপের রক্তের কোষের উপর A অ্যান্টিজেন থাকে এবং রক্তে anti-B অ্যান্টিবডি থাকে।
-
B গ্রুপ: এই গ্রুপের রক্তের কোষের উপর B অ্যান্টিজেন থাকে এবং রক্তে anti-A অ্যান্টিবডি থাকে।
-
AB গ্রুপ: এই গ্রুপের রক্তের কোষের উপর A এবং B উভয় অ্যান্টিজেন থাকে এবং রক্তে কোনো anti-A বা anti-B অ্যান্টিবডি থাকে না।
-
O গ্রুপ: এই গ্রুপের রক্তের কোষের উপর কোনো A বা B অ্যান্টিজেন থাকে না, তবে রক্তে anti-A এবং anti-B উভয় অ্যান্টিবডি থাকে।
অ্যাবো সিস্টেম অনুযায়ী রক্তের গ্রুপ নির্ধারণের জন্য আমরা সাধারণত দুইটি ধরনের অ্যান্টিবডি ব্যবহার করি:
-
Anti-A: A গ্রুপের অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে।
-
Anti-B: B গ্রুপের অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে।
ধরা যাক, কোনো ব্যক্তির রক্তের কোষে A অ্যান্টিজেন পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু B অ্যান্টিজেন পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে সেই ব্যক্তি A গ্রুপ এর হবে।
২. রেজাস সিস্টেম (Rh Factor):
রেজাস সিস্টেমের মধ্যে Rh+ এবং Rh- দুটি শ্রেণী রয়েছে। এই সিস্টেমে মূলত রক্তের কোষের উপর Rh অ্যান্টিজেন থাকে বা থাকে না।
-
Rh+ (রেজাস পজিটিভ): যদি রক্তের কোষে Rh অ্যান্টিজেন থাকে, তবে সেই রক্ত Rh+ বলে চিহ্নিত হয়।
-
Rh- (রেজাস নেগেটিভ): যদি রক্তের কোষে Rh অ্যান্টিজেন না থাকে, তবে সেই রক্ত Rh- হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এভাবে, একজন ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয় দুটি সিস্টেমের সমন্বয়ে:
-
A+, A-, B+, B-, AB+, AB-, O+, O-
রক্তের গ্রুপের গুরুত্ব:
১. রক্তদান ও রক্তসঞ্চালন:
রক্তের গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে রক্তদান এবং রক্তসঞ্চালনে। যদি রক্তদাতা এবং গ্রহীতার রক্তের গ্রুপের অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির মধ্যে অমিল থাকে, তাহলে শরীরে অ্যালার্জি বা অগ্ন্যাশয়ের প্রতিক্রিয়া (অ্যানাফাইল্যাকটিক শক) সৃষ্টি হতে পারে, যা জীবন-সংহারক হতে পারে। তাই রক্তের গ্রুপের সঠিক ম্যাচিং অপরিহার্য।
-
A+ গ্রুপের মানুষ A+, AB+, এবং O+ গ্রুপের মানুষের কাছে রক্ত নিতে পারে, কিন্তু B বা AB গ্রুপের মানুষদের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণে সমস্যা হতে পারে।
-
O- গ্রুপের মানুষ সব ধরনের রক্ত দিতে পারে, কিন্তু এটি সব সময় গ্রহণ করতে পারে না। O- গ্রুপের মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হলো O- গ্রুপের রক্ত।
২. গর্ভাবস্থা এবং শিশুর স্বাস্থ্য:
গর্ভাবস্থায়, মায়ের রক্তের গ্রুপ এবং শিশুর রক্তের গ্রুপের মধ্যে Rh সঙ্গতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যদি মায়ের রক্ত Rh- এবং শিশুর রক্ত Rh+ হয়, তবে এটি "Rh অসামঞ্জস্যতা" সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে গর্ভাবস্থায় বা শিশুর জন্মের সময় নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে (যেমন, হেমোলাইটিক ডিজিজ অফ দ্য নিউবর্ন)। এই সমস্যা প্রতিরোধ করতে বর্তমানে Rh ইমিউনোগ্লোবুলিন টিকা দেওয়া হয়।
৩. স্বাস্থ্যগত প্রভাব:
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তের গ্রুপের প্রভাব শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ:
-
রক্তের গ্রুপ O: এই গ্রুপের মানুষদের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের রোগ বা স্ট্রোক এর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম হতে পারে।
-
রক্তের গ্রুপ A: এই গ্রুপের মানুষের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বাড়তে পারে।
-
রক্তের গ্রুপ B: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এই গ্রুপের মানুষের মধ্যে পেটের সংক্রমণ (হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি) বেশি হতে পারে।
৪. অ্যান্টিবডি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা:
রক্তের গ্রুপের প্রভাব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তেও হতে পারে। কিছু রক্তের গ্রুপ যেমন O- গ্রুপের মানুষের মধ্যে পান্ডেমিক ভাইরাস যেমন ম্যালেরিয়া বা করোনা এর প্রতি কিছুটা প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে পারে। তবে এসব সম্পর্ক আরও গভীর গবেষণার বিষয়।
৫. এথনিক এবং জেনেটিক বৈশিষ্ট্য:
রক্তের গ্রুপের চিত্র অনেকটাই জেনেটিক এবং আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রুপ O পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, তবে AB গ্রুপের সংখ্যা কিছু দেশে (যেমন জাপান) তুলনামূলকভাবে বেশি।
উপসংহার:
রক্তের গ্রুপ মানবদেহে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ, রক্তদান এবং গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত বিষয়ে। তাই রক্তের গ্রুপ জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে রক্তদানে বা চিকিত্সা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে।