এমন আজগুবি মেসেজের উত্তর দেওয়ার জন্য যখন কল লগ বের করে মাইকেলকে কল দিতে যাব, তখন পেছন থেকে একটা ঠাণ্ডা হাত যেন ঘাড়ের উপরে আস্তে করে স্পর্শ করে। আচমকা ভয় পেয়ে হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্য শরীর জমে গিয়ে মনে হল, সত্যি হয়ত একটা মৃত হাত আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখি ম্যাম জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে কোমর বাঁকা করে আমার দিকে ঝুঁকে আছে। আমার এমন ফ্যাঁকাসে চেহারা দেখে ম্যাম তার চেহারা নরম করে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে? ভয় পেয়ে গেছ নাকি ? এমন মুখ হয়ে আছে কেন?
ঠিক কি উত্তর দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটা ভয়ঙ্কর দ্বিধাযুক্ত মুহূর্তে পড়ে গেছি আমি। মাইকেল মজা করে আমার সাথে। তবে এমন মজা কখনও সে করবে, মানতে ইচ্ছা করছেনা। তাছাড়া সত্যি আজ কোন কল ঢুকেনি আমার ফোনে। অথচ অন্য দিন কলের জ্বালায় ঘুমোতে পর্যন্ত পারতাম না আমি। এই মুহূর্তে অনেক আজব লাগছে ব্যাপারটা। আমি ম্যামের হাত থেকে জুসের গ্লাস নিয়ে হালকা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলি, এতো জলদি চলে এলেন যে? মাত্রই তো গেলেন।
বেশী তাড়াতাড়ি চলে এসেছি নাকি ? ফোনে কারো সাথে জরুরী কিছু ছিল?
না। মাত্রই মেডিকেলের রেডিওলোজীতে ঢুকেছি। কেও কল বা মেসেজ দিয়েছিল কিনা দেখছিলাম।
ম্যাম শাড়ীর আচল হাতে নিয়ে গা ঘেঁষে বসে আমার। কিন্তু আমার কেন যেন ধীরে ধীরে শ্বাসপ্রশ্বাস অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এমন তাও বুঝতে পারছিনা। কিছু একটা আমি বিশ্বাস করতে চাইছিনা। তবুও অস্থির করে তুলছে আমাকে ভেতরটা। আমার কিছু বুঝার আগেই ম্যাম শাড়ীর আচল দিয়ে আমার কপাল মুছে দেয়। কপাল মুছতে মুছতে তিনি খোঁচা মেরে বলে, কিছু ভেবে কি ঘাম ছুটে গেছে? প্রেমিকাকে চিট করছ ভেবে কি কষ্ট হচ্ছে ? মোবাইলটা তুলতেও ভুলে গেছ। মুহূর্তেই এমন লাগছে কেন তোমাকে? বলেছিলাম মুড পরিবর্তন না করতে। কত কষ্ট করে নিজেকে তোমার সাথে সেট করলাম। একজন মেয়ে হলে বুঝতে তুমি এটা।
আহ না ম্যাম।
কথাটা শেষ করার আগেই ম্যাম তার আকর্ষণীয় আঙ্গুল দিয়ে আমার ঠোঁট স্পর্শ করে। থামিয়ে দেয় আমাকে কথা বলা থেকে । তীক্ষ্ণ চোখ করে আমাকে বলে, একান্ত এই মুহূর্তে আমাকে অন্তত ম্যাম ডেকোনা। কল মি লেনা। প্লিজ মাই স্টেমি ক্যাট।
আমি এক চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম সেই চোখের দিকে। এই মুহূর্তে কিছুটা মনে হচ্ছে যে, আমি অন্য কোন কিছুতে আছি। জানিনা এটা মনের ভুল কিনা। ম্যাম কি আদৌ আমার সাথে এমন টা করবে?
ম্যাম তখন আস্তে করে আমার হাত থেকে জুসের গ্লাস নিয়ে নেয়। লিপিস্টিক মাখা ঠোঁট দিয়ে এক চুমুক গিলে নেয় নিজের ভেতরে। এমন দৃশ্য চলমান মুহূর্তের মাঝে হলে অন্য কোন দিকে আমি চলে যেতাম। কিন্তু এখন ভেতর থেকেই যেন কিছু আসতে চাইছেনা। গলা শুঁকিয়ে গেছে আরও। চুমুক শেষে উনি আমাকে বলে, আচ্ছা? এতটা অফ লাগছে কেন তোমাকে? কিছুক্ষণ আগেও তোমাকে অন্যরকম লাগছিল।
ম্যাম, একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে। সেটা শেষ করে আসা যাবে কি ?
একা রেখে যাবে আমাকে ?
আমি এমন প্রশ্ন শুনে স্থির হয়ে গেলাম। ঠিক কি উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। আমি কিছু বলার আগেই উনি বলে বসে, মোবাইলটা কেমন করে যেন ভেঙ্গে গেছে। কাওকে কল দিতে পারছিনা তোমাকে ছাড়া। স্ক্রিনে শুধু তোমার নাম্বার আসে। কি করে ভেঙ্গে গেছে তাও জানিনা। তাতেও সমস্যা নেই। শুধু যে তোমার নাম্বারটা উঠেছে, তাও কম নয়।
বুকটা আমার ধড়াস করে উঠল। কি বলছে এসব উনি ? আমি আর কোন কথা জিজ্ঞেস না করে উঠে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়াতেই ম্যাম যেন অন্যরকম হয়ে যায়। ভাঙ্গা কণ্ঠে আমাকে বলে, কখন আসবে ?
আরও সময় চায় আপনার?
রাত চেয়েছিলাম পুরোটা। মাত্র সন্ধ্যার শেষে রাত শুরুর দিকে।
আমি তাহলে আসছি একটা কাজ শেষ করে। জরুরী ছিল আসলে। মুড আমার পরিবর্তন হয়নি। এসে ঠিক আগের মত পাবেন আমাকে।
জুসটা শেষ করে যাও?
আমি হাত থেকে জুস নিয়ে কয়েক ঢোকেই শেষ করে দি। কিন্তু ম্যাম যেন একটা ভয়ার্ত চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিল এখনি টুঁটি চেপে ধরে সব রক্ত শুষে নিবে। এখন সত্যি ভয়ে আমার শরীরের পশম কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আমি বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে তাকিয়ে আছেন যে?
তুমি এতটা আনরোমান্টিক কেন? জানই যে আমি এখানে ঠোঁট দিয়েছি। তুমি সেখানে ঠোঁট না দিয়ে অন্য জায়গায় ঠোঁট দিলে কেন?
অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললাম, জীবন্ত একটা ঠোঁট সামনে দেখতে পাচ্ছি। গ্লাসের মাঝে কি সেই অনুভূতি পাওয়া যাবে?
ম্যাম তখন কিছুটা এগিয়ে এসে দুই হাত বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। এভাবে আগে কখনও আমি কোন স্পর্শ পায়নি অন্য কোথাও। বুকের ধুকপুকানি হয়ত বন্ধ হয়ে গেছিল কিছু মুহূর্তের জন্য। জানিনা হয়েছিল কিনা। ঠোঁটটা মুখের কাছে এনে উষ্ণ নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলে, ছুঁয়ে দিলে আমি একদম রাগ করবনা। জীবন্ত একটা লাল রঙে রাঙ্গানো উষ্ণ শুষ্ক ঠোঁট। দ্বিধাহীন ভাবে খানিকটা ভিজিয়ে দিতে পার। তোমার সামনেই আছে।
ম্যাম, কি হয়েছে আপনার?
আমি কি বেশী বেহায়া হয়ে যাচ্ছি? জানিনা কি হয়েছে আমার।
এটা বলে হাত তা ছেড়ে দিচ্ছিল ম্যাম মাথা নিচু করে। বিদ্যুৎ খেলে গেছিল সেই মুহূর্তে আমার শরীরে। আমি শক্ত করে দুই হাত দিয়ে তার নরম দুই গাল চেপে ধরি। চোখ বন্ধ করে আমার মিষ্টি মাখা দুটো ঠোঁটের পাপড়ি মিশিয়ে দিই তার দুটো ঠোঁটের মাঝে। একটা বন্ধ নিঃশ্বাসের মাঝে সব কিছুতে যেন টেনে নিচ্ছিলাম নিজের ভেতরে। উষ্ণ নিশ্বাস যেন আরও গভীরে চলে যাচ্ছিল। জিহ্বার স্পর্শের আগেই ছেড়ে দিই তার ঠোঁট।
আস্তে করে ছেড়ে দিলাম তার ঠোঁট। বুকের উঠানামা দেখেই বুঝতে পারছিলাম এখন হয়ত সে অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করছে। কথা যেন তার ঠোঁটে আঁটকে গেছিল। চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেও কিছু বলতে পারছেনা সে। আমি তখন আমার দুই হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁটের উপরে হালকা করে ছুঁয়ে দি। কিছু বলবেন না?
ফিরে আসতে দেরি হবে কি ?
যদি আর না আসি ?
অনেক অনেক কষ্ট পাব। দয়া করে কাজ শেষ করে এসো। অপক্ষায় থাকব আমি । কি খাবে তুমি রাতে?
আমি চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কি জবাব দিব বুঝতে পারছিলাম না। তবুও বললাম, এলে রান্না করে দিও। পাশে থেকে বিরক্ত করব তোমাকে।
চোখ বন্ধ করে সে তার মুখ আমার গালের কাছে নিয়ে আসে। ছোট করে শুঁকনো ঠোঁটে একটা চুমু দেয় গালের উপরে। নরম কণ্ঠে সে কানের কাছে তখন বলে, এখন মনে হচ্ছে তুমি রোমান্টিক পুরুষ। একটু আগে কেমন যেন লাগছিল।
ছুটে চললাম মেডিকেলের দিকে। ফোন দিচ্ছি মাইকেলকে। সে কল ধরছেনা। হয়ত সে আসলেই মর্গে আছে এখন। আর না হয় সে আমার সাথে চরম অভদ্রতামির মজা করছে। এটা মেনে নেওয়া যায়না। যার ঠোঁটে এমন স্বাদ, সে কিনা মারা গেছে। তাকে কিনা ময়না তদন্ত করা হবে। খামোখা নিজের ভেতরে অসহ্যের মাত্রা বাড়ানো। এটা কোন গল্পের জগত নয় যে একটা কল্পনার চরিত্রকে বিশ্বাস করে ফেলব ।
মেডিকেলে যখন ঢুকি, তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। মেডিকেলে ঢুকতেই মাইকেলের কল। একদম আজব ব্যাপার এটা। আমি রিসিভ করতেই মাইকেল আমাকে রাগ ঝারতে শুরু করে। আমি যে বিপরীতে তাকে কিছু কথা বলব , সেই সুযোগ সে দিতেই চাইছিল না। সোজা মর্গে ডেকেছে।
আমার ঘাম ছুটছে। এই মুহূর্তে অসম্ভব রকমের ঘামছি আমি। লম্বা করিডোর যেন মরীচিকার মত আরও লম্বা হয়ে যাচ্ছে। হাটতেই ইচ্ছে করছেনা। মাইকেল বলেছে ম্যাম সকালে এক্সিডেন্ট করেছে। রাত দশটার মাঝে কাজ শেষ করার কথা ছিল। মর্গে রেডিওলোজীর কোন কাজ নেই। সেটা মাইকেলের ডিপার্টমেন্টের কাজ। তবুও সে পাশে আমাকে চেয়েছে। সে চাইলেও ব্যাপারটা আমি এখনও সিরিয়াস নিতে পারছিনা। অবশেষে করিডোর শেষ হওয়ার পরে যখন আমি মর্গের সামনে আসি, মাইকেল সহ পুরো টিমকেই আমি সামনে দেখি। নিজের ভেতরে চিৎকার করে বার বার বলছিলাম," না না না না না না।" এমনটা যেন সত্যি না হয়। সাব্রিনা আমার সামনে এগিয়ে আসে। হাতে মাস্ক দিয়ে বলে, শক্ত হ। ভেঙ্গে পরিসনা। এমন না যে আমরা জানিনা তুই ম্যামকে কত পছন্দ করিস।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। ফ্যাঁকাসে মুখ নিয়ে যখন মাইকেলের সামনে এসে জিজ্ঞেস করতে যাব কিছু। সে ঝারি মেরে বলে, সর এখান থেকে। বালের পছন্দ করে। সারা দিন কোন চিপার মধ্যে ছিলি। একটা বারের জন্য ফোনে তোকে পাওয়া যায়না।
আমার ফোন সারা দিন অন ছিল। বরং তোরা কেও ফোন দিসনি। আমি একবার বলতে চাইলাম যে লেনা ম্যামের সাথে ছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি বিগড়ে দেওয়ার মত আহাম্মকটাও আমি না। তারা বিশ্বাস করার বদলে আমাকে লাথি মারবে। অথবা আমি এই পরিস্থিতি অন্য দিকে নিয়ে চলে যাব।
মাইকেল আবার চিৎকার করে বলে, তোর জন্য কত লেট হয়ে গেছে তুই জানিস? আর একটা কথা বলবি না তুই এখন আমার সাথে। ভেতরে চল।
আধুনিক মর্গের সব সিস্টেম আর ফিচার আছে এখানে। ভেতরটা থমথমে ঠাণ্ডা। একা আসলেও ভয়ের কিছুই নেই। মনে হবে যে কোন কাঁচের রুমে এসেছি হয়ত। কিন্তু এই প্রথম মর্গে আমার ভয় করছে। বুকের ভেতরের ধুকপুকানির শব্দটাও আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
মাইকেল যখন সেই ড্রয়ারের সামনে আমাকে নিয়ে যায়, আমি আরও অবাক হয়ে যাই। ড্রয়ারের উপরে লেনা ম্যামের নাম লেখা। এই নাম দেখে আমার পুরো শরীর অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কাঁপতে থাকে। মনে হচ্ছিল কিছু একটা আমার উপরে ভর করছে। এক টান দিয়ে মাইকেল ড্রয়ার খুলে দেয়। কিন্তু সত্যি আমি যা দেখলাম , তা বিশ্বাস করার মত নই। এটা লেনা ম্যাম নয়, বরং মাইকেলের নব বিবাহিতা স্ত্রী।
লেখক: আহিল আহমেদ
#চলবে_________